আজাদ তালুকদার : মামা এবং মামি দুজনেরই জ্বর, কাশি, গলাব্যথা। মামার শ্বাসকষ্টও। এভাবে প্রায় ১৫ দিন তারা পার করে দিলেন উপসর্গগুলোর সাথে যুদ্ধ করে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পর আমাকে জানানো হয় ব্যাপারটি। লাইনে দাঁড়ানো দূরে থাক, গাড়িতে চড়ে নমুনা পরীক্ষা দিতে যাবে সেই শক্তি-সামর্থ কোনোটাই নেই তাদের।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরকে জানালে পরদিন সন্ধ্যায় তিনি লালখান বাজারের বাসায় লোক পাঠিয়ে দুইজনের নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর সেই রাতেই চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের সিইও ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে মামা-মামি দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করোনা-সাসপেকটেড কেস হিসেবে মামাকে ভর্তি করানো হয়, আর প্রেসক্রিপশন দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামিকে।
এরইমধ্যে অক্সিজেনসেবাসহ আনুষঙ্গিক সুশ্রুষা পেয়ে মামা আগের চেয়ে সুস্থ। কাশি, শ্বাসকষ্ট কমেছে। তবে নতুন উপসর্গ-বুকের ব্যথা। ইসিজি করানোর পর পাওয়া গেলো কার্ডিয়াক সমস্যা। ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানালো, এই পরিস্থিতিতে যদি নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায় তবে হাসপাতালে না রাখাই উত্তম। একজন কার্ডিওলজিস্টের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনভেদে বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থেকে চিকিৎসা নিতে পারে মামা।
এবার শুরু হলো মামার রিপোর্ট সংগ্রহের লড়াই। অনেক চেষ্টার পর পরীক্ষার ৫ দিনের মাথায় স্বাস্থ্য পরিচালক সাহেব বিশেষ ব্যবস্থায় মৌখিকভাবে জানালেন, মামার রিপোর্ট নেগেটিভ। ২৪ মে রাতেই বিষয়টি ডা. বিদ্যুত বড়ুয়াকে জানাই। পরদিন সকালে ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় বর্তমান-উপযোগী ওষুধ, ছাড়পত্র এবং রুটিনমাফিক চলাফেরার ছক এঁকে মামাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। বাসায় আসার পর চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট আমাদের পারিবারিক বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী নিজেই ভিডিও কল দিয়ে মামাকে দেখভাল করেন এবং কার্ডিয়াক সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় মামা আগের চেয়ে এখন ভালো আছেন।
কিন্তু সমস্যাটা মামির বেলায়। আক্ষরিক অর্থে মামির জ্বর এখন নেই। কাশিটা আছে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটি রিপোর্টের অভাবে মামির দৈনন্দিন চলাফেরা, নাওয়া-খাওয়ায় আজ ডাণ্ডাবেড়ি। মামার ’নেগেটিভ’ জানা গেলেও মামির কী, সেটা জানা যায়নি নমুনা নেওয়ার ৯ দিন পরও।
মামির বক্তব্য হচ্ছে, যদি জানতাম আমি পজিটিভ, তাহলে আমি সম্পূর্ণ আইসোলেডেট হতাম, পরিবারে বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ুয়া দুই সন্তান ও তাদের নেগেটিভ পেশেন্ট বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতাম। যদি নেগেটিভ হতাম, তাহলে কিছুটা জ্বর অনুভূত হওয়া ছেলে এবং তার হাসপাতালফেরৎ বাবাকেও প্রয়োজনীয় যত্নআত্তি, সেবা দিতে পারতাম, সেবা নিতে পারতাম। এখন কোনোটাই হচ্ছে না, না পরিপূর্ণ আইসোলেটেড বা কোয়ারেন্টাইন, না পরস্পরের সেবা! সবচেয়ে বড় কথা, আমার সংস্পর্শে এসে নেগেটিভ রোগী যদি পজিটিভ হয়ে যায়? কিংবা আমাদের সন্তানদের যদি কোনো ক্ষতি হয়?
কেবল একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে অসম্ভব এক নিষ্ঠুর মানসিক পীড়নে দিন কাটছে একটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষিকা ওই ভদ্রমহিলা ও তার পরিবারের সদস্যদের। আইসোলেশনে থাকা করোনা পজিটিভ শনাক্ত স্বাস্থ্যপরিচালকের সাথে আজও কথা হয়েছে আমার। জেনারেল হাসপাতালের এক স্টাফ গত দুদিন ধরে বিআইটিআইডি ও চমেক ল্যাবে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন, মামির রিপোর্টের দেখা মেলেনি। একজন সংবাদকর্মীও চেষ্টা করছেন গতকাল থেকে। সবারই এক কথা রিপোর্টটিই পাওয়া যাচ্ছে না।
নমুনা পরীক্ষার ৯-১০ দিন পরও যে দেশে ফলাফল জানা যায় না কিংবা রিপোর্টটাও গায়েব হয়ে যায় সেই দেশে নেগেটিভ-পজিটিভ নির্ণয় আপনি করবেন কীভাবে? ধরুন, আপনি কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে করোনা পজিটিভি রোগী হিসেবে চিকিৎসাধীন। ৮-১০ দিন থাকার পর নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠালেন। ৮-১০ দিন পর আপনার রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। এরপর আপনি ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িও চলে গেলেন। কিন্তু এই ৮-১০ দিন অন্য করোনা-পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে চলতে গিয়ে আপনি ফের সংক্রমিত হবেন না তার নিশ্চয়তা কী?আর সেরকম একজন করোনাজয়ী করোনা-আক্রান্তের শরীরে রক্তের জলীয় অংশ সরবরাহ দিচ্ছেন প্লাজমা বলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার সেই রক্ত কতটা নিরাপদ? কতটা জীবাণুমুক্ত?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানলাম, গত ২৭ মে ঢাকা আইইডিসিআরে নমুনা পরীক্ষা করে সাতক্ষীরায় দুই নারীর শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। অথচ দুজনের একই নমুনা প্রথমে খুলনায় পরীক্ষা হলে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩০ নং পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলামের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষা করে তাঁর রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় ঢাকায় গিয়ে পুনরায় টেস্ট করান তিনি। সেখানে করোনা পজিটিভ আসার ৫ দিন পর মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি।
চট্টগ্রামে যার নেগেটিভ ধরে নিয়ে প্লাজমা সংগ্রহ করা হচ্ছে তার আদৌ নেগেটিভ কিনা- সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যেহেতু রিপোর্ট নয়-ছয়ে ভরা। কাজেই বাংলাদেশের মতো দেশে রক্তের প্লাজমা হস্তান্তর নতুন বিপদ ডেকে আনবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
যদিও ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত দেশগুলোতে পরীক্ষামূলক প্লাজমা থেরাপি কিছুটা ফল দিয়েছে। কারণ সেইসব দেশে নমুনা পরীক্ষার ঝক্কিঝামেলা নেই। একটি ফার্মেসিতেও নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। রিপোর্টও পাওয়া যাচ্ছে সাথে সাথে। ফলে মুহূর্তেই জানা সম্ভব হচ্ছে নেগেটিভ, পজিটিভ ফলাফল।
এরপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীর অ্যান্টিবডি অন্য করোনা রোগীকে আদৌ সুরক্ষা দেবে কি না, সেটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়।
প্লাজমা থেরাপির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সরকারের করা কারিগরি উপ কমিটির প্রধান ডা. এম এ খান সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বড় ধরনের কোনো গবেষণা না হওয়ায় এর সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকারিতা ও কতখানি নিরাপদ, তা সম্পর্কে ধারণা কম থাকাতে ঢালাওভাবে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
আমি প্লাজমা থেরাপির বিপক্ষে নই, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এটি কতটা নিরাপদ, ফলপ্রসূ, যুক্তিযুক্ত সেটা জানতেই এই পোস্ট বা লেখা। কারো জানা থাকলে আমাকে জানাবেন প্লিজ! আমি জানতে চাই, শিখতে চাই।
লেখক : সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।