রেহানা বেগম রানু : প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশের ভাবমূর্তিই কেবল উদ্ধার করেনি, ক্ষয়ে যাওয়া, ভূলুণ্ঠিত মানবতার আকাশ ভেদ করে জ্বলে উঠা এক নতুন নক্ষত্রের নাম ‘শের আলী’। বলছিলাম, দুর্ঘটনা কবলিত ৫ বছরের শিশু কন্যাকে বাঁচাতে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করা সিএমপির গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত কনস্টেবল শের আলীর কথা।
গত ১১ আগস্ট ২০১৬। রামুর পানিরছড়ায় দুর্ঘটনায় পড়ে একটি যাত্রীবাহী বাস। বাস উল্টে ঘটনাস্থলে মারা যান ৪ জন। আহত হন ২১ জন। খবর পেয়ে রামুর গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাওয়া শের আলী দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন ৫ বছরের এক কন্যাসন্তানের রক্তরাঙা শরীর।
শের আলীর বিবেক আটকে পড়ে গাড়ির চাকায় জীবনঝুঁকিতে আটকে থাকা ফুটফুটে শিশুটির কাছে। পরম মমতায় শিশুটিকে উদ্ধারের পর ক্লান্ত হয়ে শের আলীর বুকেই লুটিয়ে পড়ল শিশুটি। আস্তে আস্তে বলতে লাগল, আব্বু আমি পানি খাব। শিশুটির তৃষ্ণার্ত আকুতিতে শের আলীর সামনে মুহূর্তে ভেসে উঠে তার ৫ বছরের আত্মজা ‘মীম’-এর নিষ্পাপ মুখখানি। শের আলী হয়ে উঠেন প্রবল আবেগী। নিজের অজান্তেই হু হু করে কেঁদে উঠে পিতৃহৃদয়।
শিশুটিকে তার কন্যা মনে করে পরম স্নেহে চুম্বনের পর চুম্বন দিতে থাকে। অতপর দৌড়ে দ্রুততম সময়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান। শের আলী সেদিন সময়মতো শিশুটিকে হাসপাতালে যদি নিয়ে না যেতেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হয়তো শিশুটির জীবনশঙ্কা থেকেই যেতো।
কেউ দুঃসাহসী কিংবা মহৎ কাজ করলে আমরা তাকে বাহবা দিই- ‘বাঘের বাচ্ছা বাঘ’ বলি, ‘শের-এর বাচ্চা শের’ বলি। আসলে কথাটি এভাবেই বলা উচিত- ‘মানুষের বাচ্চা মানুষ’। কারণ মহৎ, সাহসী ও শ্রেষ্ঠ মানবতা কিন্তু মানুষই করতে পারে, দেখাতে পারে। জঙ্গলের হিং¯্র প্রাণী ‘বাঘ’ নয়।
কিন্তু মানবতার ক্ষয়িষ্ণু যুগ-সন্ধিক্ষণে এসে মানুষকে ছাড়িয়ে আমরা বনের বাঘকেই শ্রেষ্ঠার্থের উপমায় ব্যবহার করছি। বলছি বাঘের বাচ্ছার মতো কাজ করেছে। কিন্তু আজকের শের আলীর মনুষ্যত্ববোধ, মানবতার ঝাণ্ডা আবারও প্রমাণ করলো প্রাণীকূলে মানুষই আশরাফুল মাকলুকাত। মানুষই পারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে। শের আলীর এই মানবিক দৃষ্টান্তের পর আমার মনে হয় আগামীতে শের আলীই বড় উদাহরণ হতে পারে। এখন থেকে বলা হোক ‘বাঘের বাচ্ছা বাঘ’ নয়, ‘মানুষের বাচ্ছা মানুষ’। আর এই উদাহরণ তৈরির সবটুকু কৃতিত্বই আমি দিতে চাই মানুষের বাচ্চা মানুষ শের আলীকে।
দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি কেউ যদি নিজের প্রিয়জন, স্বজনের কথা ভেবে কাজ করে সেই কাজে প্রাণ থাকে। যে কাজে প্রাণ নেই সেই কাজের মাধ্যমে প্রাণরক্ষা করা সম্ভব নয়। শের আলীরও কাজে, কর্তব্যনিষ্ঠায় প্রাণ ছিল। তাই তিনি ছুটি কাটাতে গিয়েও বিশ্রামে-আয়েশে ঘরে বসে থাকেননি। দুর্ঘটনার খবর শুনেই ছুটে যান কাজের প্রতি প্রাণ আছে বলেই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে শুধু শিশু উম্মে হাবিবার প্রাণরক্ষা করেননি, রক্ষা করেছেন পুলিশ বিভাগের মান।
পুলিশ বিভাগের অনেক বদনাম থাকলেও সুনামও আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতায় সাধারণ মানুষের প্রাণরক্ষার পাশাপাশি দেশকে রক্ষা করতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই জীবনবাজি রেখেছিলেন। আর সেই সময়টাতে জীবন দিয়েছিলেন পুলিশের ১২২ জন সদস্য। ২০১৪ সালের শুরুতে দায়িত্ব পালনের সময় রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের তা-বে শরীর-মাথা থেতলে গিয়েছিল এক পুলিশ সদস্যদের। বিউটিপার্লারকর্মী ঝর্ণা বেগমই সেদিন মুমূর্ষু সেই পুলিশ সদস্যকে বাঁচাতে মানবতার মশাল জ্বালিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
অনেকেই যখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, যন্ত্রনায়-কষ্টে একাকি পড়ে থাকা পুলিশ সদস্যের দিকে ফিরে তাকানোর একটুও ফুরসত নেই তখন এই ঝর্ণা বেগমই মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ছুটে গিয়েছিলেন।
শের আলী ও ঝর্ণা বেগম সমাজ, রাষ্ট্রের উঁচু পদে আসীন কেউ নন। কিন্তু শের আলী, ঝর্ণার যা আছে তা রাষ্ট্র-সমাজের বড় বড় পদ দখল করে থাকা অনেকেরই নেই। তাই বলি, শেরআলী-ঝর্ণারাই ১৫ কোটি মানুষের সেরা মানুষ। তারাই বাংলাদেশ। তারাই মানবতার মূর্তপ্রতীক।
রেহানা বেগম রানু আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী, প্রাক্তন কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন