সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার চোখের জলে ভিজছে কারাগারের মেঝে

প্রকাশিতঃ ১৩ মার্চ ২০২০ | ২:১৯ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম : দেশকে হানাদারমুক্ত করতে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। নিজের জীবন যাক, বিনিময়ে দেশ শত্রুমুক্ত হোক। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াই করেছেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। চালিয়েছেন বহু সফল অপারেশন। এসব অপারেশনের একটি রাউজানের কুখ্যাত রাজাকার টিক্কা খান খতম অপারেশন।

পাকসেনাদের সহযোগী হিসেবে মুক্তিকামী মানুষদের নিধনযজ্ঞ আর একের পর নিরীহ মা-বোনদের হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়ে রাজাকার টিক্কা খান যখন পাকবাহিনীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন তখনই গর্জে উঠলেন সেই বীরসেনানী, গুলিতে হত্যা করলেন তাকে।

একদিকে টিক্কা খান হত্যামামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা, অন্যদিকে পাকবাহিনীর মৃত্যু পরোয়ানা-কঠিন এক শপথ, সতর্কতায় হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে যুদ্ধ করলেন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ পর্যন্ত। শত্রুর মোকাবিলায় মরতে মরতেও বেঁচে গেলেন। এ যেন মিরাকল! মেয়াদোত্তীর্ণ জীবন, নতুন জীবন। দেশ তো শত্রুমুক্ত হলো, স্বাধীন হলো। আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, নস্যির আর বেঁচে না থাকলেও চলে। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন্ এই বেঁচে থাকা, নতুন জীবন পাওয়া সাহসী মানুষটির আর কোনো চাওয়া-পাওয়া না থাকারই কথা এবং নাই-ও। সেই চাওয়া-না চাওয়ার সমীকরণেই পার করছিলেন জীবন। চিকিৎসা পেশায় মানবতার অপার দ্বার খুলে দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে দিতে সকল যুগসন্ধিক্ষণে এগিয়ে গেছেন, যুদ্ধ করেছেন নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে। সারাজীবনের সেই যোদ্ধা, আগুনঝরা মানুষটিই এখন কারাগারে।

আলোচ্য মানুষটি চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান বাবুল। তিনিসহ ৭ জন মিলে জেনারেল হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনা বাবত ৯ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন-এই অভিযোগে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠিয়েছেন চট্টগ্রাম স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক শেখ আশফাকুর রহমান।

এরপর প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে সমুদ্রচুরির মতো ভয়াবহ ঘটনায় জড়িতরাও যেখানে বহাল তবিয়তে, হাজার-লক্ষ কোটি টাকা দুর্নীতির যেখানে কিনারা নেই- সেই দেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিচারের আগেই কারাগারে যেতে হয়। কী সেলুকাস!

এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল হক বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এ মামলাটি করেন। মামলায় সরফরাজ খান বাবুল ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন ডাক্তার আবদুর রব, মঈন উদ্দিন মজুমদার ও বিজন কুমার নাথ এবং জাহেদ উদ্দিন সরকার, মুনশি ফারুক হোসেন ও আফতাব আহমদ। তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন চিকিৎসক আর অন্যরা ঠিকাদারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে এ দুর্নীতি হয়েছিল বলে মামলার এজাহারে লেখা রয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে যন্ত্রপাতি কিনে ৯ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৫ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২০১৪ সালে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে এ দুর্নীতি হয়।

মামলায় সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান বাবুল সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে আত্মসমর্পণের শর্তে হাইকোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন পেয়েছিলেন। মেয়াদ শেষে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

সেই থেকে চট্টগ্রাম কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে কাটছে এই মুক্তিযোদ্ধার দিনগুলো। বুধবার (১১ মার্চ) কারাগারে সরফরাজ খান বাবুলের সাথে দেখা এবং কথা হয় একুশে পত্রিকা সম্পাদকের। ঘটনার আকস্মিকতায় হতব্হ্বিল তিনি। একেবারে চুপচাপ, খুব বেশি কথা বলছেন না।

শুধু বললেন, মূলত তিনি ছিলেন সিভিল সার্জন। পাশাপাশি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের বাড়তি দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তিনি আলোচ্য অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কোনোভাবে জড়িত নন। অনিয়ম যেহেতু হয়েছে, সেহেতু ‌‌’বাই চেয়ার’ তার নামটাও এসে গেছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি এসবের কিছুই জানেন না। এরপরও নিজের নাম যেহেতু এসেছে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। পরবর্তীতে সম্মান জানিয়ে নিম্ম আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। বিচার শুরু হয়নি, দোষী সাব্যস্ত হননি, কিন্তু তার আগেই আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন।

‘১৯৭১ এ-ই তো মরে গিয়েছিলাম। বার বার ফিরে এসেছি মৃত্যু উপত্যকা থেকে। এটা আমার মেয়াদোত্তীর্ণ জীবন। এই মেয়াদোত্তীর্ণ, বাসি জীবনটার জন্য আমি অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি করে টাকা উপার্জন করবো চিন্তাও করতে পারি না। দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন শপথ নিয়েছিলাম, জীবনের মায়া ত্যাগ করে। জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে আমার কপালে এঁকে দেওয়া হলো দুর্নীতির কলঙ্কতিলক। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আমরা ৭ জনে মিলে ৯ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছি। তাই যদি হয় একজনের ভাগে হয়তো এক কোটি টাকার বেশি পড়বে। যেখানে জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলাম, তুচ্ছ করেছিলাম, সেখানে মাত্র এক কোটি টাকার মোহে আমি জড়িয়ে গেলাম। কী অদ্ভুত কথা, বিচিত্র সমীকরণ- দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বললেন ডা. সরফরাজ খান বাবুল।

একুশে/এটি