চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ভর্তি বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজনের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। টিপু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাসির উদ্দিনের অনুসারী ও সুজন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বৃহষ্পতিবার সকালে ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নেয় নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। এ সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় আব্দুর রব হলের দিকে ধরে নিয়ে যায় তারা। ওই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা বলে সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা সাড়ে তিন লাখ টাকা চায়। এ টাকার মধ্য থেকে দেড় লাখ টাকা ওই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী নাছির গ্রুপকে পরিশোধও করে। পরে এ টাকা থেকে ভাগ চায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। ভর্তি বাণিজ্যের এ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ। এর জের ধরে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী তৌহিদুল ইসলাম নাছির গ্রুপের অনুসারী ইকবাল হোসাইনকে ‘সালাম না দেওয়ার’ অভিযোগ তুলে মারধর করে।
এরপর ইকবাল বিষয়টি নাছির গ্রুপের নেতাকর্মীদের জানালে শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। সংঘর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় রেল স্টেশনে শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ জালাল হল ও শাহ আমানত হলে। নাছির গ্রুপের নেতাকর্মীরা শাহ জালাল হলের সামনে অবস্থা নেয়। মহিউদ্দিন গ্রুপের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয় শাহ আমানত হলের সামনে। দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। এ সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ২০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গুরুতর আহত অবস্থায় ১০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) পাঠানো হয়।
এদিকে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে নাছির গ্রুপের অনুসারী হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম হাসানকে আমানত হলের সামনে নাশতা করতে গেলে মারধর করে মহিউদ্দিন গ্রুপের অনুসারীরা। তাকে কাঁচের বোতল দিয়ে মাথায় ফাটিয়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চবি মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর নাছির গ্রুপের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকে শাহ জালাল হলের সামনে। মহিউদ্দিন গ্রুপের নেতাকর্মী জড়ো হয় শাহ আমানত হলের সামনে। একপর্যায়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের দিকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মশিউদ্দৌলা রেজা এসে ছাত্রলীগ কর্মীদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। এরপরও সংর্ঘষ না থামলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পরে দুপুর দেড়টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি, শাহ আমানত ও শাহ জালাল হলের প্রভোস্টের উপস্থিতিতে হলগুলোতে তল্লাশী চালায় পুলিশ। এ সময় আমানত হলের ২৫টি রুম ও শাহ জালাল হলের ২২টি রুমের তালা ভাঙে পুলিশ। এসব কক্ষ থেকে ৩০টি রামদা, ১৮টি রড, পাঁচ বস্তা পাথরসহ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে চবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সভাপতি গ্রুপের অনুসারী ইমতিয়াজ অভির উপর হামলা চালিয়েছে প্রয়াত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর অনুসারীরা। পরে তাকে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার দুই পা ও হাতের হাঁড় ভেঙে গেছে বলে হাটহাজারী উপজেলা মেডিকেলের ডাক্তাররা জানিয়েছেন।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের দুই পক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ালে পুলিশ তাদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা এরপরও ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। পরে পুলিশ কিছুটা কঠোর হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দুটি হলে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় ৩৯ জনকে আটক করা হয়। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন, ‘ছোট একটা বিষয় নিয়ে জুনিয়রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। পরে বিষয়টি অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। আমরা এ ব্যাপারটি মীমাংসা করেছি। তবে যে বা যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন মীমাংসার ব্যাপারটি অস্বীকার করে বলেন, ‘বিনা উসকানিতে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গতকাল রাতে আমার নেতাকর্মীদের উপর সভাপতি গ্রুপের অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে। আজ আবার পুলিশ তল্লাশীর নামে আমার নেতাকর্মীর উপর হামলা ও আটক করেছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাচ্ছি। অন্যথায় আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।’
এ ব্যাপারে চবি প্রক্টর আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘সহিংসতার কারণ এবং হলগুলোতে বহিরাগত আছে কিনা কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে কিনা- তা যাচাই করার জন্য হল দুটিতে তল্লাশী চালানো হয়। এ সময় বেশকিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সন্দেহভাজন শিক্ষার্থীদের আটক করেছে।’