চট্টগ্রাম : সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হওয়ার সুযোগ রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ এর খসড়া অনুমোদনকে আত্মঘাতি বলে উল্লেখ করেছেন গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে যুক্ত চট্টগ্রাম ফাইট ফর উইমেন রাইটস-এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু।
তিনি বলেন, বিশেষ ধারা সম্বলিত বাল্যবিয়ের নতুন আইনে আমি হতাশ। আমি বিক্ষুব্ধ। মনে হচ্ছে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমাদের এতদিনকার যুদ্ধ, সংগ্রাম সবই বৃথা গেলো। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বলেও মনে করেন অ্যাডভোকেট রানু।
বৃহস্পতিবার ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’ এর যে খসড়া মন্ত্রীসভা অনুমোদন করেছে, তাতে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলের বয়স ২১ বহাল রাখলেও এই আইনের বিশেষ ধারায় (১৯ ধারা) সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় ১৮ এর নিচেও বিয়ের বিষয়টি বৈধ করা দেয়া হয়েছে।
আইনের ১৯ ধারায় বিশেষ বিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ ও মা-বাবার সম্মতিতে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হতে পারবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, অবিবাহিত মা বা অন্য কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বেলায় এই বিধান প্রযোজ্য হবে।
এই বিশেষ বিধানের ব্যাপক অপব্যবহারের আশঙ্কা করে অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, এই আইনের ফাঁক গলে বাল্যবিবাহ বৈধতা পেয়ে যাবে। তাই আইনে এমন কোনো জায়গা রাখা ঠিক হবে না, যাতে সুযোগসন্ধানীরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাল্যবিয়ের উৎসবে মেতে উঠতে পারে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ রেহানা বেগম রানু মনে করেন, আদালত ও বাবা মায়ের সম্মতির কথা বলা থাকলেও আমাদের দেশে যারা মেয়ের বাল্যবিবাহ দেন, তাদের মধ্যে কতজনের আদালত পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা আছে? আইনের নজরদারিই বা কতটুকু হয়? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি বলেন, সমস্যাটা ছেলে-শিশুদের নিয়ে নয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কন্যা শিশুদেরই শিকার হতে হচ্ছে বাল্যবিবাহের। ভাবতে অবাক লাগে, যখন সমাজ একদিকে নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে তখনই সরকার এধরনের আইন করতে যাচ্ছে।
তিনি জানান, যারা কন্যা শিশুদের বাল্যবিবাহ নামের কুপ্রথার যূপকাষ্ঠে বলি দিচ্ছে, তারা জানে এটি একটি শাস্তিযোগ্য বেআইনী কাজ। আর সে জন্যই তারা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ কাজটি করছে অত্যন্ত গোপনে। বয়স গোপন করে, লুকিয়ে, এক শ্রেণীর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে লোভ দেখিয়ে বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা শিশুর বিয়ে দিয়ে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে সেইসব কন্যাশিশু অকাল মাতৃত্ব, অকাল বৈধব্য, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তাদের জীবনের সব সম্ভাবনাকে দিচ্ছে জলাঞ্জলি। দারিদ্র্য, পারিবারিক গঞ্জনা ও স্বাস্থ্যহানির অভিশাপ নিয়ে হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাজ-সংসারের বোঝা। যারা বিয়ে দিয়ে, বিয়ের গীত গেয়ে, নেচে-মেতে বিয়ের ব্যয়বহুল ভোজের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সামন্ত প্রথায় বালিকা বধূটিকে দোয়া-আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন, তারা দুর্দশাগ্রস্ত হতভাগ্য সেই বালিকা বধূর করুণ জীবনের খোঁজ নিতে আর ফিরেও আসেননি- বলেন রানু।
তিনি বলেন, বিয়ের পূর্বশর্তই হচ্ছে, মেয়ের ১৮ বছর এবং ছেলের ২২ বছর হতে হবে। তার আগে ছেলে এবং মেয়ে দুজনই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। কাজেই তাদের দুজনের সম্মতিত সম্মতি নয় আইনের দৃষ্টিতে। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী কোনো নারী ২১ বছরের আগে সন্তান প্রসব করলে সন্তান ও মা দুজনেরই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য হবে, জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তারা পরিবার ও সমাজের বোঝা হবে এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের অন্তরায় হবে। একজন কন্যা সন্তানের ১৮ বছরের আগে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটে না এবং সংসার করার জন্য যে মানসিক পরিপক্কতা দরকার তাও ১৮ বছরের আগে আসে না। এই অবস্থায় সরকারের এই আইন বাল্যবিয়েকে রীতিমতো উসকে দেবে। বাল্যবিয়ে রোধের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক সমস্ত অর্জনকে ম্লান করে দেবে বলে মনে করেন রেহানা বেগম রানু।
রানু বলেন, এই সরকার নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে নারীকে সম্পৃক্ত করেছে। স্থানীয় সরকার, মন্ত্রীসভা, রাজনীতিতে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে নারীবান্ধব সরকার হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছে যে সরকার, সেই সরকারই আবার বাল্যবিয়ে নিয়ে কেন এই লুকোচুরি খেলছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এদিকে সরকারের পক্ষে এই আশঙ্কাকে অমূলক বলা হয়েছে। ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সাংবাদিকদের বলেন. যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো ঘটনা ঘটলে আদালত ও বাবা-মায়ের সম্মতি থাকলে তবেই বিয়ে হতে পারে। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করলেও কিশোর-কিশোরীদের প্রেম বন্ধ হয়ে যাবে এমনটি নয়। কোনো কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে তখন তার ভবিষ্যৎ কী হবে? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী কিশোরীর থাকার জায়গা না থাকলে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মঙ্গলজনক মনে না হলে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।’
প্রতিমন্ত্রীর এই যুক্তি ও ব্যাখ্যার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, মন্ত্রীর এই বক্তব্য কতটা যৌক্তিক আমার বোধগম্য নয়। আমি মনে করি তার এই বক্তব্য বাল্যবিয়ে রোধ করার চেয়ে কিশোর-কিশোরির অবাধ প্রেম-ভালোবাসা এবং কিশোর বয়সে গর্ভধারণে উৎসাহ জোগাবে।
‘মাঠে-ঘাটে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি বাল্যবিয়ে কত ভয়াবহ একটি অভিশাপ। আর এই অভিশাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে বার বার করুণ কাহিনীর পুনরাবৃত্তিই শুধু দেখেছি। যখনই খবর পেয়েছি ছুটে গেছি হতভাগ্য কন্যা শিশুর জীবন বাঁচাতে। নিজের সীমিত সাধ্য, স্থানীয় আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহায়তা এবং শুভাকাক্সক্ষীদের নৈতিক সমথর্নই ছিলো আমার ভরসা।’
ফাইট ফর উইমেন রাইটস-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন কাউন্সিলর রেহানা বেগম রানু গত ২৫ বছর ধরে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তার কঠিন যুদ্ধের ইতিবৃত্ত জানাতে গিয়ে উপরের কথাগুলো বললেন অত্যন্ত আবেগতাড়িত কণ্ঠে।
তিনি জানান, রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শুধু মাওলানা ডেকেও বিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক কন্যাশিশুকে। এদের অনেকে আবার স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পর দেনমোহরের টাকাতো দূরে থাক, সামান্য ক্ষতিপূরণের টাকাও পায়নি। এদের উদ্ধার করে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ের জন্য আইনগত সহায়তা প্রদানেরও কাজ করছে ফাইট ফর উইমেন্স রাইটস।
অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু জানান, তিনি সারা দেশে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি কন্যা শিশুকে অভিশপ্ত বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। অনেক কন্যাশিশুকে উদ্ধার করে দীর্ঘদিন তার নিজের ঘরেই রাখতে হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। চট্টগ্রামে সরকারি কোনো উইমেন্স শেল্টার নেই। পরে এইসব অসহায় কন্যাশিশু এবং স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের তিনি তার সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, প্রথমে এই কাজটি শুরু করার পর বহু স্বার্থান্বেষী লোক তার কাছে এসে অভিযোগ করে বলেছে, ‘আপনি কী শুরু করেছেন। আপনি মানুষের বিয়ে ভাঙছেন কেনো?’
২০০৮ সালে মহানগরীর রাজাপুকুর লেইন এলাকায় হৈমন্তি নামের এক শিশুকন্যাকে তিনি বাল্যবিবাহের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রভাবশালীদের কোপানলে পড়েন; কিন্তু ধৈর্য্য ও অনড় অবস্থানের মধ্য দিয়ে অবশেষে হৈমন্তিকে বাঁচাতে সক্ষম হন। তার কাছেই জানা গেলো- তার সংগঠনের দ্রুত হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন কন্যাশিশুর নাম। তারা হলো- সানজিদা হোসেন চৌধুরী, সেলিনা আক্তার, নাসরিন আক্তার, মোসাম্মাৎ মনি, শারমিন আক্তার, হাজেরা আক্তার, ফাতেমা আক্তার এবং তাসলিমা আক্তার। নিরবচ্ছিন্ন এই কাজটি তিনি করে চলেছেন দেশি-বিদেশি কোনো অনুদান সহায়তা ছাড়াই।
অ্যাডভোকেট রানু বলেন, জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে। এখন ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকসহ অনেকেই বাল্যবিয়ে নিয়ে সোচ্চার, সরব। আমি যখন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ শুরু করি তখন পুরো পথটাই ছিল পিচ্ছিল, বৈরি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ঘরের খেয়ে বিরামহীন এই কাজে গ্রাম-গ্রামান্তর চষে বেড়িয়েছি বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে। যখন আমরা এই স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে তখনই নতুন আইনে বিশেষ ধারা সংযোজন করে প্রকারান্তরে বাল্যবিয়েকেই বৈধ করার প্রয়াস চলছে।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিসহ নীতিনির্ধারকরা আশ্বস্ত করেছিলেন, আইনের ধারা থেকে বিশেষ ধারাটি বাদ যাবে। এখন প্রত্যাশা, জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করবেন। বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে দেশকে রক্ষা করবেন।
কথোপকথন : ওয়াহেদ বুলবুল অর্পণ