মন্ত্রী হওয়ার গল্প : ফোন পেতে দেরি হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন জাভেদ

javedওয়াহেদ বুলবুল : ১২ জানুয়ারি ২০১৪, শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আগের দিন রাত থেকে গুলশানের ফ্ল্যাটে বসে মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেতে অধীর অপেক্ষা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের। এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাভেদের বর্তমান সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) রিদোয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম, আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী, আনোয়ারার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আসহাবউদ্দিন, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট অজিত কুমার বৈদ্যসহ জনা আটেক লোক।

এর মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন টেলিভিশন-স্ক্রলে সম্ভাব্য মন্ত্রীসভার সদস্যদের তালিকা প্রচার করা হচ্ছে। প্রচার হচ্ছে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের নামও। কিন্তু চূড়ান্ত ডাক না পাওয়া পর্যন্ত এসব কিছুই বিশ্বাস করতে চান না জাভেদ। সময় যতই গড়াচ্ছে ততই স্নায়ুর চাপ বাড়তে থাকে তার। এরমধ্যে পরিচিত কয়েকজন মন্ত্রীপরিষদ সচিবের ফোনও পেয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতীক্ষিত ফোনটি বেজে উঠে না জাভেদের। বরং টিভি-স্ক্রল দেখে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে যারাই ফোন করছেন তাতে চরম বিরক্ত হচ্ছেন তিনি।

এ ধরনের ফোনে একপর্যায়ে এপিএস সায়েমের দিকে ফোন ছুঁড়ে দেন জাভেদ। বলেন, ‘ফোন ধরো, কী বলতে চায় দেখো।’ এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ তুলে জাভেদ বলেন, তিনি আমাকে মন্ত্রীত্ব দিবেন আমি বিশ্বাস করতে চাই না। তিনি আমাদের পরিবারকে পছন্দ করেন না। আমার বাবাকে (আখতারুজ্জামান চৌধুরী) অপমান করেছেন, শেষপর্যন্ত আমাকেও অপমান করবেন- বলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এ পর্যায়ে রক্তচাপ বেড়ে গেলে তাকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেন সবাই। জাভেদ যখন শারীরিক, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত তখনই (রাত সাড়ে ১১টা) কাঙ্ক্ষিত ফোনটি বেজে ওঠে।

: সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ সাহেব বলছেন?
: জ্বি, বলছি
: আমি মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁঞা। কাল ১০ টার মধ্যে বঙ্গভবনে চলে আসুন। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আপনি শপথ নিবেন।

ফোন রেখেই উপস্থিত সহকর্মীদের বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাভেদ। এ কান্না যেমন আনন্দের, তেমন বেদনারও।

বেদনা এ কারণে যে, এর তিন বছর আগে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর মন্ত্রীসভার রদবদল ও নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান। শীর্ষ নেতাদের সিগন্যালে মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সুদূর লন্ডন থেকে চলে এসেছিলেন তার প্রয়াত বাবা বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। সম্প্রসারিত মন্ত্রীসভায় স্থান পেতে ২৯ নভেম্বর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঢাকার বাসভবনে অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ডাক না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আখতারুজ্জামান বাবু।

দীর্ঘদিন পর কথাগুলো বলছিলেন পিতা-পুত্রের মন্ত্রী হওয়া না হওয়ার দুটি ঘটনার অন্যতম সাক্ষী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি।

একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জীবনে একটিবার মন্ত্রী হয়ে মরতে চেয়েছিলেন। ’৯১ সালে যখন এমপি হন তখন ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় তখন শিল্পপতি হুমায়ুন জহির হত্যামামলার ষড়যন্ত্রমূলক আসামী হয়ে তিনি দেশান্তরী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এমপি হন আখতারুজ্জামান বাবুও। আশায় বুক বাঁধেন, এবার তিনি মন্ত্রী হবেন, স্বপ্নের পতাকা উড়াবেন।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রীসভায় স্থান না পেলেও দীর্ঘদিন সেই আশা জিইয়ে রাখেন- প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার মন গলবে, কোনো এক সময় মন্ত্রী হবেন। অতপর স্বপ্নের পতাকা উড়িয়ে এলাকায় যাবেন। তখন অপেক্ষাকৃত অনেক জুনিয়র নেতা শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পেলেও শেষপর্যন্ত স্থান হয়নি প্রবীণ এই নেতার।

তিনি বলেন, জীবনে সব পেলেও এই একটিমাত্র অপ্রাপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাঁকে। অপারেশনের পর যখন বুঝলেন তাঁর সময় শেষ, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে বললেন, আপা আমি চলে যাচ্ছি। আমার ছেলে জাভেদকে আপনার কাছে রেখে গেলাম। অন্তিম যাত্রার কালে আখতারুজ্জামান বাবুর এই আবেগময় কথোপকথন হয়তো নেত্রীর দাগ কেটেছিল। সে কারণেই রাজনীতিতে অভিষেক হয়েই ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাবুর জ্যেষ্ঠ সন্তান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। বলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই লোক।

তিনি জানান, বঞ্চনার দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না প্রতিমন্ত্রী জাভেদ। তাই মন্ত্রীর ‘আমন্ত্রণ’ পেতে দেরি হওয়ার বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে ইমোশনাল হয়ে উঠেছিলেন।