শরীফুল রুকন : ১৯৩০-এর ৩০ মে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ছোলতান প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছিল ‘বন্দুকের গুলিতে মি. গান্ধী নিহত’। যদিও মহাত্মা গান্ধী গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি।
মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন অহিংস জননেতা এবং বিশ্ব জুড়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় পথপ্রদর্শক। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার বাণী এখনো সবার প্রেরণা ও অনুসরণীয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে যতটা প্রাসঙ্গিক ছিলেন তিনি, আজও ততটাই।
নিছক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৯৩০ সালে গুলিতে গান্ধী নিহত উল্লেখ করে চটকদার শিরোনামটি করেছিল দৈনিক ছোলতান। সংবাদের বিস্তারিত বিবরণে জানানো হয়, ইউরোপীয়ানদের একটি নাটকে গুলিতে গান্ধীর নিহত হওয়ার অভিনয় করা হয়েছে।
গণমাধ্যমে তখনও যেমন অবাক করা শিরোনাম ছিল, এখনও তাই। বর্তমানে অনেক অনলাইন পোর্টাল তার হিট বাড়ানোর জন্য শিরোনাম করছে চটকদার। খবরের শিরোনামে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া থাকছে না বা পৃথকভাবে দেওয়া তথ্য অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে। পুরো খবর পড়ার পর পাঠক বুঝতে পারছেন শিরোনামের সঙ্গে খবরের মিল নেই। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে।
জলছাপ বইয়ের লেখক ও চট্টগ্রামের সন্তান তারিকুল ইসলাম জুয়েলের সংগ্রহশালায় রয়েছে দৈনিক ছোলতানের ১৯৩০ সালের ৩০ মে সংখ্যাটি। ছোলতানের উক্ত সংখ্যায় প্রথম পাতায় তৃতীয় কলামের শুরুতে শিরোনাম করা হয়, “বন্দুকের গুলিতে গান্ধী নিহত”; যদিও উপশিরোনামে লেখা হয়, “শিলচরে শেতাঙ্গদিগের বিচিত্র অভিনয়”।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “শিলচর, ২ শে মে। শিলচরের ইউরোপীয় বাসিন্দাগণ গান্ধীর নির্ব্বুদ্ধিতা শীর্ষক একখানি নাটক অভিনয় করিয়াছে। এই নাটকের আখ্যায়িকায় দেখান হইয়াছে ধাসনা লবণ গোলা আক্রমণ করা হইল। খদ্দর পরিধান করিয়া ও মাথায় গান্ধী টুপী লাগাইয়া একজন ইউরোপীয় গান্ধীর পাঠ অভিনয় করে। গান্ধী এক দল স্বেচ্ছাসেবক লইয়া লবণ গোলা আক্রমণ করিতে উদ্ধত হইয়াছেন সরকারী কর্মচারীরাই বাধা দিতেছে। এই কর্মচারীরা আক্রমণকারীদিগকে চাবুক মারিতে থাকে, পরিশেষে মহাত্মাকে গুলী করিয়া মারা হয়।
মহাত্মা গান্ধীর অপমানজনক এইরূপ অভিনয়ে এই শহরের অধিবাসীরা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। এ বিষয়ে প্রতীকার প্রার্থনা সরকারের গোচরীভূত করা হইয়াছে।”
প্রসঙ্গত ১২ মার্চ ১৯৩০। লবণের উপর কর চাপিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইনের প্রতিবাদে আমদাবাদের কাছে সবরমতী আশ্রম থেকে সমুদ্রের পাড়ের ছোট্ট গ্রাম ডান্ডির উদ্দেশে রওনা দেন মহাত্মা গান্ধী। ২৪ দিন ধরে পায়ে হেঁটে ৩৮৬ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আইন ভেঙে লবণ তৈরি করেন তিনি। একই সঙ্গে তৈরি হয় ইতিহাস।
এ যাত্রায় গান্ধীর সঙ্গী হয় হাজার হাজার ভারতীয়। ব্রিটিশরা এর বদলা নিতে ৬০ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তবে এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অন্যতম সফল আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তি হয়। গান্ধীকে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৪২ সালে ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি ভারত ছাড় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান মহাত্মা গান্ধী। একই বছরের ৯ আগস্ট তাঁকে আবারো গ্রেপ্তার করা হয় এবং পুনের আগা খাঁ প্যালেসে আটকে রাখা হয়। ১৯৪৩ এর শেষের দিকে যখন ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীকার প্রদানের অঙ্গীকার করে তখন থামে এই আন্দোলনটি। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার দেখা পায় ভারত।
স্বাধীনতার পরে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা সভা করতেন মহাত্মা গান্ধী। সেখানে সব ধর্মের কথা বলা হতো, যাতে অংশ নিতেন কয়েকশ’ মানুষ। প্রতিদিনের মতো ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, সেদিনও সন্ধ্যার প্রার্থনা সভার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গান্ধী। ঠিক সেই মূহুর্তেই নাথুরাম গডসে খুব কাছ থেকে পিস্তলের তিনটি গুলি ছোড়েন তাঁর বুক লক্ষ্য করে, গডসের করা সেদিনের গুলিতেই মৃত্যু হয় মহাত্মা গান্ধীর।
মৃত্যুর এতবছর পেরিয়ে গেলেও পুরো বিশ্ববাসী এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন মহান এই নেতাকে। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। শান্তির স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে, তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করে গেছেন অন্যরকম এক দৃষ্টান্ত। অহিংসার ধারণা সম্পর্কে মহাত্ম গান্ধী লিখেছেন, “যখন আমি হতাশ হই, আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে। দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত তাঁদের পতনই ঘটে।”