এসএম ইকরাম হোসাইন : ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। অনাদিকাল ধরে জনশ্রুত এই প্রবাদটা আমাদের অবচেতন মনে নিজের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসকে গ্রাস করে রেখেছে বলেই আমাদের অপেশাদার চেতনা জগতে পুরোনো ধ্যান-ধারণা দিব্যি অক্টোপাসের শৃঙ্কলের মতো জঁটলা পাঁকিয়ে রাখে, যেখানে উঠে না নতুনত্বের আলোড়ন, জাগে না নবজয়ের উচ্চাশা!
নির্মোহ ঘুমের ঘোরে রঙিন স্বপ্ন বুনতে বুনতে বাস্তবায়নের যুদ্ধে ব্রত হওয়ার আগেই যেন চোখের পলকে বিলীন হলো ২০১৯, আর পঞ্জিকার পাতায় ঠাঁই নিলো ২০২০!
নতুন দিনে জীবনের জন্য নতুনত্ব আনতে চাই সবাই, চাই বিনিদ্র স্বপ্নগুলোকে উষ্ণ দুহাতে ছুঁয়ে দেখতে; অথচ সীমিত এ জীবনটায় স্বপ্ন দেখার সময়টা দীর্ঘ করে ধরার সময়টাকে আমরা এতবেশি ক্ষীণ করে ফেলি যে অপ্রস্তুত – কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি বছরের শেষ সময়টায় এসে। কেননা ফেলে আসা সময়ে সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, আশা-নিরাশার হিসেব মিলাতে মিলাতেই ভুলে বসি আমরা আমাদের নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা; পুরোনো নিয়ে মত্ত চিন্তাজগত। নিরাশার জড়তা কাটিয়ে উঠতেই চলে যায় নতুন বছরের অর্ধেকটা সময়, ফলে বছর শেষে আবারো সেই অপ্রাপ্তির পুরোনো ক্রনিক হতাশারা ঝেঁকে বসে চিন্তার জগত জুড়ে!
তাই বছর শেষে এই ক্রনিক ডিপ্রেশন রোধ করতে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই ভাবতে হবে, পরিকল্পনা সাজাতে হবে কীভাবে কাটাতে চান নতুন বছরটা, তৈরি করতে হবে নিজের কর্মপঞ্জিকা। তবে নতুন বছরের সব পরিকল্পনা খুব সহজেই বাস্তবায়িত হবে এমন ভাবার কারণ নেই। বাধা-বিপত্তি আসবেই, তা প্রতিরোধ করার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে আগে থেকেই। রাখতে হবে দৃঢ় মনোবল। মনে রাখা জরুরি, দশটা সাফল্যের চেয়ে একটা ব্যর্থতাই আমাদের বেশি পীড়া দেয়, তাই সেই ব্যর্থতার জায়গাগুলোকে সফলতায় ট্রান্সফর্ম করতে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে প্ল্যান বি রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।
এখন যদি প্রশ্ন আসে, এই নতুন বছরে আমার কর্মপন্থা কী হতে পারে- নিশ্চয় বলবেন গতানুগতিক ধারায় নিজেকে বদলানোর জন্য একাধিক সংকল্প করবো, সুস্বাস্থ্য অর্জন, অপচয় রোধ কিংবা হ্যান্ডসাম ইনকাম অথবা কোনো বদভ্যাস বর্জনের প্রচেষ্টা? ভুল কিছু নয়, তবে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যুগের পালে হাওয়া লেগেছে বহু আগেই। পৃথিবী এগিয়েছে বহুদূর, শুধু পিছিয়ে আছি আমি-আপনি।
কেন? উত্তর খুব সহজ। সময়ের চাহিদাগুলো নিজের মাঝে ধারণ করার অক্ষমতার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। শুধুমাত্র আমাদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এর দিকেই দেখুন না, প্রজন্মের সিংহভাগ পার্সোনাল প্রোফাইল রিচ করা কিংবা সময়োপযোগী স্কিল ডেভেলপমেন্টের পরিবর্তে এখনো বইয়ের অক্ষরে আর মুখস্থ বিদ্যায় নিজের স্বপ্ন বোনেন! শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রেডিং পদ্ধতি আমাদের করে রেখেছে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন, জাতিগতভাবে বিভক্ত! তাই ইন্টারপার্সোনাল কিংবা পেশাগত দক্ষতা অর্জনের চেয়েও সিজিপিএ অর্জনেই কাটিয়ে দিই আমরা পুরোটা ছাত্রজীবন।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ‘ফোর্বস ম্যাগাজিন’-এ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ এ ক্যারিয়ার কিংবা নানা উদ্যোগে আপনাকে এগিয়ে রাখতে প্রয়োজন ১০টি বিশেষ স্কিল বা দক্ষতা। উল্লেখিত স্কিলগুলো হলো – জটিল সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ক্রিয়েটিভিটি, অন্যকে ম্যানেজ বা কনভিন্স করার ক্ষমতা , মানুষের সঙ্গে সমন্বয় করা কিংবা সামাজিকতা, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, বিচার ও ডিসিশন নেয়ার সামর্থ্য, সেবা দেয়ার মানসিকতা, নেগোশিয়েশন এবং মানসিক শক্তি।
একটু চিন্তা করুন তো, মোবাইল ফোনের শুরুর দিকটা। এটি কেবলই কমিউনিকেশনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতো। কিন্তু আমরা ডিভাইসটির নিত্যনতুন ফিচার ব্যবহার শিখে নতুন নতুন অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি, জীবনকে সহজতর করে তুলছি। ঠিক তেমনি, সময়ের সাথে তাল মিলের যুগের ফিচারগুলোও আমাদের ধারণ করতে হবে, নয়তো বিবর্তনবাদের স্রোতে যোগ্যতরের ঠিকে থাকার লড়াইয়ে বিলীন হতে হবে আপনাকে আমাকে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে সাতপাঁচ ভাবতে থাকলে পিছিয়ে পড়বেন নির্দ্বিধায়। তাই সময় ক্ষেপণ না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরের শুরু থেকেই যুগের ফিচারগুলো আয়ত্তে আনার চেষ্টা করুন। লক্ষ্য নির্ধারণ করে ঝুড়িভর্তি করুন আপনার প্রয়োজনীয় স্কিলগুলো দিয়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি, যে সংকল্পই আপনি গ্রহণ করুন না কেন, তা অর্জনের জন্য আপনার যা অবশ্য প্রয়োজন তা হলো মোটিভেশন তথা নিজের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। কিন্তু আমরা সবাই জানি সেই উদ্দীপনা তৈরি করা কতটা কষ্টকর।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্যানট্রন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ বছরের শুরুতে নেওয়া সংকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু আপনাকে সেই ৯২ শতাংশ ব্যর্থ মানুষের তালিকায় থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কীভাবে আপনি সফলতাকে অর্জন করতে পারেন সে চেষ্টা করে দেখুন; আপনার জন্য শুভেচ্ছা।
এস এম ইকরাম হোসাইন : উদ্যোক্তা ও ই-এক্টিভিস্ট