চট্টগ্রাম: পবিত্র রমজান আসতে প্রায় একমাস বাকি। আর এ রমজানকে সামনে রেখে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে রোজার প্রধান অনুষঙ্গ ছোলা, খেসারি ও মসুর ডালের বাজার দর। উৎপাদন ও আমদানি কম ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকায় রোজার আগে পণ্যগুলোর দাম আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা।
বছরের শুরুতে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় ভালো মানের বিদেশি রসুন বিক্রি হয়েছে। আর দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। মঙ্গলবার রাজধানীর খুচরা বাজারে একই মানের বিদেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায়। আর দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। এ হিসেবে প্রতি কেজি বিদেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১৩৫ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। আর দেশি রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। ভর উৎপাদন মৌসুমে রসুনের দাম বৃদ্ধির স্পষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছেন না পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।
তবে রমজানকে কেন্দ্র করেই দাম বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। রমজান আসতে এখনও মাসখানেক দেরি। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না মর্মে আশ্বস্ত করে আসছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে বিভিন্ন শাস্তির কথাও বলে আসছেন তিনি। তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর এসব ঘোষণা আর প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এরই মধ্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, চিনি ও ছোলার দাম।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে রসুনের দাম বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। আর আমদানি করা ভালো মানের রসুনের দাম বেড়েছে গড়ে ১৬৭ শতাংশ। সংস্থাটির হিসাবে এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। আর লবণের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ। রমজানে বহুল ব্যবহৃত ছোলার দাম এক বছরে ৫২ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম এক মাসে বেড়েছে ১৮ শতাংশ। মসুর ডালের দাম গড়ে ২২ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
রমজান সমানে রেখে বাড়তি লাভের আশায় কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই বছর ধরেই নিত্যপণ্যের দামে নি¤œমুখী প্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া ভারতসহ অনেক দেশের মুুদ্রার মান কমে আসায় ওইসব দেশ থেকে পণ্য আমদানিকারকরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। এ সুবিধা ভোক্তাদের না দিয়ে উল্টো তারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বৃদ্ধির প্রবণতা সহসা কমার সম্ভাবনা নেই। প্রশাসনের জোরদার মনিটরিংয়ের মাধ্যমেই কেবল দাম নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। এদিকে সারা দেশের মতো প্রতি বছর রমজানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারও ব্যতিক্রম দেখতে পারছেন না ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা ছোলার দাম বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক বুকিং রেট বৃদ্ধির কথা বলছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজি আড়াল করতে প্রতি বছর নানা অজুহাত খাড়া করা হয়। এবার তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) নির্বাহী পরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, এ মুহূর্তে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। পবিত্র রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এবার অনেকটা আগেভাগেই বাজার উত্তপ্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েক বছর ধরে সরকার রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর অবস্থানে ছিল। এ কারণে ব্যবসায়ীরা কৌশল পরিবর্তন করেছেন। এবার আগেই সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে রমজানে স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে টিসিবিকে আরও কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে। আগেভাগেই পণ্য ছেড়ে বাজার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সরকারের উচিত আগেভাগেই বাজার মনিটরিং জোরদার করা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মঙ্গলবার প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়। প্যাকেটজাত ছোলার দাম ছিল কেজিপ্রতি ১০০ টাকা। গত বছরের একই সময়ে পণ্যটির দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে ৫২ শতাংশ বেড়েছে ছোলার দাম। ভালো মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। এ পণ্যটির দাম এক বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে বলে টিসিবির পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এক বছর আগে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে এ পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। এতে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ১৭ টাকা পর্যন্ত।
এদিকে রমজানকে সামনে রেখে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বেসামাল অবস্থা। রজমানে ব্যবহৃত প্রতিটি পণ্যের দামই পাইকারি ও খুচরাপর্যায়ে বাড়ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণ ছোলার দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। পাইকারি আড়তে প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়েছে ৮৫ টাকা। আর খুচরাপর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলার দাম নেয়া হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত। অথচ এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, প্রতি বছর সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। যার বড় অংশের চাহিদা থাকে রমজানে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭১ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত মাসে আরও অন্তত ৫০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছে। তারপরও ছোলার দাম কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছোলার পাশাপাশি বাড়ছে রসুনের দাম। মোটর ও খেসারি ডালের দামও বাড়ছে। খেসারির ডাল প্রতি কেজি এখন ৮০ টাকায় ছুঁয়েছে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহমদ জানান, ছোলা, ডাল, চিনির আমদানি ঘাটতি তেমন নেই। তবে ছোলার বুকিং রেট কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। তাই পাইকারি ও খুচরাপর্যায়ে ছোলার দাম বাড়ছে। দাম যাতে ক্রেতার সহনীয় পর্যায়ে থাকে সেজন্য ব্যবসায়ীরা সতর্ক আছেন।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ইলিয়াস হোসেন জানান, কোন আড়তে কত মজুদ আছে তা বলা মুস্কিল। তবে রমজানে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ করার মতো নিত্যপণ্য মজুদ আছে খাতুনগঞ্জে। যেসব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তার লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। অন্যথায় রমজানের ঠিক আগ মুহূর্তে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।