:: সাঈদ আহসান খালিদ ::
ভাবুন তো- অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গী করে কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন, মনে আশা- দু’জনে বহুদিন পর একান্তে সময় কাটাবেন, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে মুখোমুখি বসে, করতলে বিশ্বস্ত হাত রেখে পরষ্পরের চোখের ভাষা পড়ায় বুঁদ হয়েছেন, ভাবছেন- ‘এখন তো সময় ভালবাসার/ এ দু’টি হৃদয় কাছে আসার..’
অমনি বেজে উঠলো মুঠোফোন- স্ক্রিনে অফিসের ‘বিগ- বস’ এর নাম্বার। গ্রিন বাটন চাপতেই বিনা মেঘে বজ্রপাত- অফিসে জরুরী কাজ হাজির হয়েছে, ফিরতে হবে- বসের আদেশ! ছুটির আনন্দ আর সব রোমান্টিক প্ল্যান কর্পূরের মতো উবে গেলো। চাকুরি বাঁচাতে অফিসের বস তো সামলালেন কিন্তু ঘরের বস কে কী করে সামলাবেন? অসুখ আর অতৃপ্তির বীজ যে বুনে দিলেন, নিজেও ত্যক্ত- বিরক্ত হয়ে অফিসে ফিরলেন, ওদিকে সম্পর্কে ঘুণপোকা কুটকুট করে কাজ শুরু করে দিয়েছে…
এই আধুনিক ‘টেকনো কমিউনিকেশন’ এর যুগে অফিস থেকে ‘ডিসকানেক্ট’ হওয়ার সুযোগ কই? ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে রিপোর্টিং বস কে বন্ধু বানিয়েছেন, হোয়াটস আপ, ভাইবার, ইন্সটাগ্রাম, ইমো আর ইমেইল তো আছেই। প্রথাগত ‘অফিস আওয়ার’ এখন আর পালন করার সুযোগ কোথায়? পেশাগত জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন এখন মিলেমিশে একাকার। ৯-৫ টার অফিস ঘন্টা সেরে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরছেন বটে- কিন্তু বস আর অফিসিয়াল কানেকটিভিটি’ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হতে পারছেন কি? ‘বসের একটি কল- সারা সপ্তাহের দু:খ’, পুরো উইকএন্ড মাটি!
কক্সবাজারে মারমেইড ইকো রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে সামান্থা ফুলার নামে এক ব্রিটিশ মহিলার সাথে একবার আড্ডা জমেছিল। বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) তে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট হিসেবে সে কাজ করে তখন। মারমেইডে টানা ১৫ দিন বিশ্রাম আর ছুটি কাটাতে এসেছে। আড্ডায় জানা গেল সে স্বেচ্ছায় তাঁর মোবাইল, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সব ঢাকায় ফেলে এসেছে, ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে রেখেছে আসার আগেই। সঙ্গে এনেছে শুধু কিছু বই- সব ফিকশন। সামান্থার কথা হল- ছুটি মানে ছুটি- কাজ, অফিস, ব্যস্ততা, যোগাযোগ সব থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে নিজের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করার নামই ‘অবকাশ যাপন’। মোবাইল সাথে রাখা মানে ‘টেনশন বক্স’ সাথে রাখা।
ছুটির দিনের কথা বাদ দেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কোনো মোবাইল ফোনই ব্যবহার করেন না। ২০১০ সালে তিনি তার মোবাইল না থাকার কথা জানিয়ে বলেন- ‘আমার যদি মোবাইল থাকত তাহলে সেটা সবসময় বাজতেই থাকত..’
কাজ কিংবা ছুটি কোনটাই আসলে আমরা উপভোগ করতে শিখিনি। অফিসের কাজে ফাঁকি মারি আর ছুটি বরবাদ করি কাজের ডেডলাইন তাড়া করে। বাসার ঝামেলা টেনে আনি অফিসে, অফিসের চাপ ছাপ ফেলে বাসায়। নিজের কাজ আর ছুটিকে পৃথক করা জানতে হবে, সম্মান জানাতে হবে ছুটিতে অন্যদের অফিস হতে ”বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার’ কেও।
খুশির কথা- অফিস সময় শেষে এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার বা ‘Right to Disconnect’ কে সম্প্রতি শ্রম অধিকারের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত ফ্রান্সে স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাশ করা হয়েছে! ফ্রান্সের সংশোধিত এই শ্রম আইনের ২৫ অনুচ্ছেদে ‘Le droit de la déconnexion’ বা ‘Right to Disconnect’ কে নতুন শ্রম- অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে বলা হয়েছে- ‘ফ্রান্সের কোন কোম্পানি যেখানে ৫০ জনের অধিক কর্মী আছে- সেখানে নির্ধারিত অফিস সময়ের পরে কর্তৃপক্ষ কোন কর্মীকে অফিসিয়াল কাজে ই-মেইল করতে পারবে না’।
এই আইনে স্বীকার করা হলো- চাকুরি করা মানেই কোন কর্মী ‘সবসময় এভেইলেভল’ বলে বিবেচিত হবে না, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সময়কে সম্মান করতে হবে, আলাদা রাখতে হবে। এই ‘Right to Disconnect’ নতুন মানবাধিকার হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আশা করা যাচ্ছে- এর মধ্য দিয়ে ‘জীবন’ ও ‘কর্ম’- এই দুইয়ের মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা হবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার ভিত্তিতে কাজ করে তাদের জন্য এই বিধান বেশ বিপত্তিজনক হবে বটে!
এই ‘right to disconnect’ কবে নাগাদ বাংলাদেশে আইনি অধিকারের স্বীকৃতি পাবে বা আদৌ পাবে কিনা- কেউ জানিনা কিন্তু নিজেরা তো ব্যক্তি-জীবন ও পেশা-জীবনের মধ্যে সেই সামান্থা ফুলার নামের নারীটির মতো ‘বিচ্ছেদ রেখা’ টানতে পারি, ‘কাজ’ ও ‘ছুটি’– দুটোই উপভোগ করতে পারি, অন্যকে একই সুযোগ দিতে পারি।
পণ্ড ছুটিতে প্রিয় মানুষের হাত ছেড়ে তাহলে আর কাউকে বেজারমুখে অফিসগামী গাড়ির হ্যান্ডেল ধরতে হবে না..!
লেখক: শিক্ষক, আইন অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: সাঈদ আহসান খালিদ এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া।