চট্টগ্রাম : বাসার বাবুর্চিকে মালিক সাজিয়ে অন্যের প্লট বিক্রি করে দিয়েছিলেন আজকের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রভাবশালী ক্রেতারা চড়াও হন সামশুলের উপর। শেষপর্যন্ত টাকা ফেরৎ দিয়ে ওই প্লট প্রথমে নিজের ভাইয়ের নামে এবং পরে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করেন সামশুল হক চৌধুরী।
বিষয়টি জানার পর প্লটের প্রকৃত মালিক হাজির হন সামশুল হক চৌধুরীর কাছে। উল্টো সামশুল হক তাদের হুমকি দেন, বলেন এই জায়গা তার নিজের কেনা, এ বিষয়ে নাক গলালে পরিণতি খারাপ হবে বলেও জানান। থানায় এ ব্যাপারে সামশুল হকের বিরুদ্ধে জিডি হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো প্রভাব খাটিয়ে সেই প্লট ভোগদখল করে আছেন হুইপ সামশুল।
পুরো ঘটনা প্রবাহ ২০০১ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে হলেও এতদিন জানাজানি হয়নি। কেউ কেউ জানলেও প্রভাবশালী হুইপের ভয়ে মুখ খুলেনি কেউ। সম্প্রতি হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তার পুত্রের নানা কাণ্ডের মধ্যে শনিবার নতুন করে উঠে এসেছে প্লট কেলেঙ্কারির এই বিষয়টি।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিসিএস প্রশাসন সমিতির মাধ্যমে কর্ণফুলী ব্রিজ সংলগ্ন বাকলিয়া এলাকায় নিজের নামে নেয়া ৭ শতকের একটি প্লট হাজী মো. শফি প্রকাশ টুনু কাওয়ালের কাছে ৫৬৭৬ দলিল মূলে ১৯৯৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিক্রি করেন আনোয়ারা উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল হায়দার।
২০০০ সালের দিকে আজকের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ ও পটিয়ার খরনা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা একেএম মতিনসহ তিনজনে মিলে ঢাকায় একটি বাসায় নেন। সেখানে রান্নাবান্না করার জন্য পটিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া হয় সোলেমান নামের এক লোককে। তিনি তাদের রান্না করে খাওয়াতেন, ফুটফরমায়েশ খাটতেন।
২০০১ সালের ১৫ অক্টোবর বাসার বাবুর্চি সোলেমানকে হাজী মো. শফি সাজিয়ে প্লটটি চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বর্তমান সরকার দলীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম চৌধুরীর ভ্রাতৃবধূ খুরশিদা খানমের কাছে ৬৩২৭ দলিল মূলে ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন সামশুল হক চৌধুরী। রেজিস্ট্রি অফিসে বাবুর্চি সোলেমানকে হাজী মো. শফি প্রকাশ টুনু কাওয়াল মর্মে শনাক্ত করেন সামশুল হক চৌধুরী নিজেই। ভুয়া মালিকের কাছ থেকে জায়গা কেনার বিষয়টি জানতে পেরে খুরশিদা খানমের স্বামী জসিম উদ্দিন চৌধুরী মন্টু সামশুল হককে চাপ দিতে থাকেন। একইসাথে ভুয়া বিক্রেতা বাবুর্চি সোলেমানকেও চাপ দেন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ।
একপর্যায়ে ঝামেলা থেকে বাঁচতে ২০০২ সালের ৩০ অক্টোবর আদালতে হলফনামা দিয়ে মোহাম্মদ সোলেমান জানান যে, আমি পটিয়া থানার খরনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম মতিন সাহেবের মাধ্যমে পরিচিতির সূত্রে উপরোক্ত একেএম মতিন, মুসলিম উদ্দিন এবং সামশুল হক চৌধুরীর একত্রে ভাড়ায় নেওয়া ঢাকাস্থ বাসায় আমি তাদের অধীনে বাবুর্চি হিসেবে চাকরি নিই। চাকরিরত অবস্থায় আমি ছুটিতে চট্টগ্রামে গ্রামের বাড়িতে আসলে ২০০১ সালের ১৫ অক্টোবর উক্ত সামশুল হক চৌধুরী সাহেব আমাকে খবর দিলে আমি তার জুবলী রোডস্থ অফিসে আসি। সামশুল হক চৌধুরী আমাকে বলেন যে, তার এক চাচা বর্তমানে খুবই অসুস্থ আছেন। তার পক্ষে বর্তমানে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে তার পক্ষে একটি দলিলে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে টিপ দিতে হবে। আমি সামশুল হক চৌধুরীর উপস্থিতিতে তার কথা অনুযায়ী তার অনুগত কর্মচারী হিসেবে দলিলে ও বহিতে টিপ দিই। আমি কোনরকমে সাধারণ পড়তে পারি ও দস্তখত জানি। কিন্তু শুধু টিপ দিতে হবে বলায় টিপ দিই। আমি উক্ত দলিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমাকে কেউ কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। উক্ত দলিলে সামশুল হক চৌধুরীও সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেন।
হলফনামায় সোলেমান আরো বলেছেন, কিন্তু ইদানীং সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষিতে উক্ত দলিলের গ্রহীতা পক্ষ আমাকে মূল দাতা মনে করে ২০০১ সালের ১৫ অক্টোবর দলিল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি উক্ত সম্পত্তির মালিক নই এবং আমি সামশুল হক চৌধুরীর কথা ও নির্দেশ মতে তার চাচার স্থানে টিপ দিয়েছি বলে জানাই। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতে জটিলতা পরিহারকল্পে সততার ভিত্তিতে আমি হলফনামামূলে প্রকৃত তথ্য ও সত্য বর্ণনা করলাম। ২০০১ সালের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম সদর সাব রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে আমার দেওয়া টিপের সত্যতা প্রমাণের জন্য নিম্নে আমার টিপ প্রদান করলাম।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে খুরশিদা খানমের কাছ থেকে প্লটটি ভাই মাহবুবুল হক চৌধুরীর নামে রেজিস্ট্রি করে নেন সামশুল। ভাইয়ের হাত ঘুরে সেই প্লটটির মালিক এখন সামশুল হক চৌধুরী নিজেই। ২০০৬ সালের ১২ জুন ৫৭০৯ দলিল মূলে মাহবুবুল হক চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন সামশুল হক চৌধুরী।
এদিকে মূল মালিক হাজী মো. শফির ছেলে মোহাম্মদ মোক্তার ২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর নগরের বাকলিয়া থানায় সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, পাওনা সম্পত্তির জন্য সামশুল হক চৌধুরীর কাছে গেলে উল্টো তিনি আমাদের হুমকি দেন, বলেন এই জায়গা তার নিজের কেনা, এ বিষয়ে নাক গলালে পরিণতি খারাপ হবে বলেও জানান।
অভিযোগের বিষয়ে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, এখন নতুন নতুন আবিষ্কার করতেছেন। এগুলো আমি কিছু জানি না। যারা জানে তাদের সাথে কথা বলেন, অসুবিধা কী। মূল মালিক কি আপনাকে কিছু বলেছে? মূল মালিক শফির ছেলে-মেয়েরা আমার স্ত্রীর কাছে বিক্রি করে চলে গেছে।
এসময় একুশে পত্রিকা ও পত্রিকার সম্পাদক নিয়ে বিষোদগার করেন হুইপ।