বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: কক্ষচ্যুত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ


রুবাইয়াত ফাহিম : ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫। বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সূচনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর আদর্শকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর উন্মেষ ঘটেছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের বাঙালির ম্যগনাকার্টা খ্যাত বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এর মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমাদের সকল অর্জন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন। এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের আরেকটি বড় অর্জন ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর আদর্শকে বুকে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার গুরুগম্ভীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই কাজে তিনি পুরোপুরি সফল হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে রাতারাতি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলা সম্ভব ছিল না। তখনকার স্নায়ুযুদ্ধ কালীন বিশ্বব্যবস্থা আরো কঠিন করে তুলেছিল পরিস্থিতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা করেছিল বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশীয় পরাশক্তি চীন। স্বাভাবিক ভাবেই তারা চাইছিল না বাংলাদেশ সফল হোক। সাথে তো তাদের এদেশীয় এজেন্টরা ছিলই।

এর বাইরেও বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল অনেক কাজ। বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে স্বীকৃতি দেয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি এক্ষেত্রে দ্রুত সফল হয়েছিলেন।। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করেছিলেন। বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়েছিলেন অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা হিসেবে। দেশের সমস্যা সমাধানকল্পে নিচ্ছিলেন যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত। তখনই আসল ২৫ শে মার্চ এর মত আরেক কাল রাত।

যে কোন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাসবিদরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাকারীরা স্নায়ুবিশ্বযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে দেখিয়েছেন, ভারতীয় গবেষকদের কেউ কেউ উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রভাব হিসেবে দেখিয়েছেন। আমাদের এ দেশীয় রা এক এক সময় এক এক ঘটনাকে সামনে এনেছেন। আবার ক্ষমতার পালাবদল এর সাথে সাথে সেগুলো পরিবর্তন ও হয়ে গিয়েছিল।

আমার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এর পেছনে মুল কারণ ছিল ৪টি। যথা-
১. সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভুমিকা।
২. ক্ষমতায় আরোহনের বামপন্থীদের বিশেষকরে জাসদ ও তাদের সৃষ্ট গণবাহিনীর উচ্চাভিলাষী চিন্তা।
৩. তৎকালীন আওয়ামীলীগের গুটিকয়েক সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতা ।
৪. পাকিস্তানের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী হল বামপন্থীরা। বিশেষ করে জাসদ। তারাই সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ (চীন) ও পরোক্ষ (আমিরেকা) মদদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু কে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার কে অজনপ্রিয় করে তুলেছিল। দেশ গঠনে প্রতি পদে পদে বাধা দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহেরের নেতৃত্বে গণবাহিনীর একাংশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত একটি দেশ পরিচালনা করা অবশ্যই কঠিন। এখানে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা না পাওয়ার বেদনা থাকবেই। সেটাকেই মূল উপজীব্য বানিয়ে তারা কিছু তরুণ কে উচ্চাভিলাষী স্বপ্নে বিভোর করে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল।

বামপন্থীদের তৈরি করা জল আরো ঘোলা হয়েছিল আওয়ামীলীগের ভিতরকার খন্দকার মোশতাকের মতো কিছু কুলাঙ্গারের কারণে। এই ঘোলা জলে মাছ শিকারের পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল পাকিস্তানের পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসররা। তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিল চরম সুবিধাবাজ এক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক বিপরীত আদর্শ পানে।মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছিল একটি প্রজন্মকে। যার ধারাবাহিকতায় একটি প্রজন্ম হারিয়ে ফেলেছি আমরা। যেই প্রজন্ম জামাত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিল।

তবে সুখের বিষয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কে। এখনকার প্রজন্ম আবারো বেড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু কে বুকে ধারণ করে। বাংলাদেশ কে তারা নিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধতর পথে। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তর করবে তারা নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
সরকারি কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম
ও সাধারণ সম্পাদক, কমার্স কলেজ শিক্ষক সমিতি।