তৌফিকুল ইসলাম সৌরভ, ঢাকা : ২০০৮ সাল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্দান্ত দাপটের শেষ মহড়া। এর মধ্যেই দুই দলের শীর্ষ নেত্রীসহ বাঘা বাঘা সব নেতা ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের খাঁচায় বন্দী। চলমান রাজনীতিতে একটা শুদ্ধি অভিযান কিংবা রাজনীতিতে সংস্কারের আওয়াজ উঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পাশাপাশি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের মাঝেও। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগেও গঠিত হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে ৬৪ সদস্যের সংস্কার কমিটি। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে সেই কমিটির একজন ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ। দলের সংস্কারে কমিটির সদস্যদের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত আসে। তখন আওয়ামী লীগে গবেষণাধর্মী প্রায়সব কাজই করতে হয় আবু সাইয়্যিদকে। তাই দলের আধুনিকায়ন প্রশ্নে আবু সাইয়্যিদও নিজের মতামত তুলে ধরেন সংস্কার কমিটির কাছে। তিনি বিশ্বের ৯৮ টি গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দেন সেই মতামতে; এসব দেশে যিনি প্রধানমন্ত্রী হন তিনি দলীয় প্রধান থাকেন না, অথবা যিনি দলীয় প্রধান থাকেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে যান না। সংস্কার কমিটির ৪৮ সদস্যই জোরালো সমর্থন দেন তাতে।
আবু সাইয়্যিদ গুনাক্ষরেই ভাবেননি সহজ-সরল, সাদামাটা মতামতটাই রাজনীতিতে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। শেখ হাসিনার কাছে তার মতামতটাকে অতিরঞ্জন করে তুলে ধরেন তারাই, যারা এর পক্ষে বাহবা দিয়েছিলেন। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা ‘ভুল’ বুঝলেন আবু সাইয়্যিদকে। সৃষ্টি হলো মান-অভিমান, তারপর দূরত্ব। ছিটকে পড়লেন তিন তিনবারের এমপি এবং ’৯৬ থেকে ২০০১ এর তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়্যিদ। দলীয় মনোনয়ন থেকেই শুধু বঞ্চিত হননি; বাদ পড়েন দলের সকল কর্মকাণ্ড থেকে।
‘আমি কোনোভাবেই সেই মতামতে শেখ হাসিনাকে বাদ দেওয়ার কথা বলিনি। অথচ দলীয় প্রধানকে সরাসরি বাদ দিতেও বলেছিলেন সংস্কার কমিটির অনেক নেতা। আমার মতামতটা ছিল স্রেফ উপমা। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে যে রাজনীতির চর্চা হয়, তাদের অবয়ব কেমন সেটাই আমার মতামতে তুলে ধরেছিলাম। মূলত আমার কথাটা ছিল সোজাসাপ্টা, অতি সারল্যময়। আর এই সারল্যপনার ভুল ব্যাখ্যা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি করে দিলো।’
সম্প্রতি একুশেপত্রিকাডটকমের সঙ্গে একান্ত আড্ডা, আলাপচারিতায় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ার বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরলেন বঙ্গবন্ধুর একসময়ের বিশ্বস্ত সিপাহশালার, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ড. অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ। সেই আলোচনায় উঠে আসে তাঁর রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব, বঙ্গবন্ধুর অপত্য স্নেহে কীভাবে বাংলাদেশ বিনির্মাণের সারথী হয়েছিলেন-তার আদ্যোপান্ত।
আবু সাইয়্যিদ আড্ডার শুরুটা করলেন শৈশবের বেড়ে উঠা, রাজনীতিক হয়ে উঠার গল্প দিয়ে। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালে পাবনায়। বাবা নাজির উদ্দিন সরকার ডাক বিভাগের কর্মকর্তা (পোস্ট মাস্টার) ছিলেন। মা সাইয়িদাতুন্নেসা গৃহিণী। তাঁর দাদার দাদা আবদুল কাদির খান ছিলেন ভারতের পাটনার জমিদার। সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে সিপাহী বিপ্লবের পর ভারতের পাটনা থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পাবনা অঞ্চলে এসে বসতি করেন। তার পরিবারের সদস্যরা ইউনিয়ন, জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। তাই নেতৃত্বেও বিষয়টা পারিবারিকভাবেই পাওয়া। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নৌকার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেন আবু সাইয়্যিদ। বাবা ছিলেন মুসলিম লীগ সমর্থক। তার ভগ্নিপতি প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন। বাপ-চাচারা সবাই তার পক্ষে কাজ করছেন। আর আবু সাইয়্যিদ ও তার ভাইয়েরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেন।
১৯৫৭ সালে পাবনা বিপিন বিহারী হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় স্কুলের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। এসময় প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আসেন বিপিন বিহারী স্কুল পরিদর্শনে। মন্ত্রীর প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং পাবনাবাসীর আনুগত্য, স্যালুট আর সম্মান-সমীহ দেখে সেদিনের কিশোর সাইয়্যিদ মনে মনে সংকল্পবদ্ধ হলেন বড় হয়ে মন্ত্রী-এমপি হবেন। হয়েছেনও তাই। এ জন্য নিজেকে পাড়ি দিতে হয়েছে জীবনের নানা বাঁক, নানা পথ।
সেই বাঁক আর পথের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হওয়ার মধ্যদিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মিশে যেতে সময় লাগেনি আবু সাইয়্যিদের। নেতৃত্ব দেন শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে। এ কারণে পাকিস্তান আর্মির রোষানলেও পড়তে হয় তাকে। বার বার আর্মিরা হানা দেন। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দারোয়ানের সহযোগিতায় আর্মির হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান আবু সাইয়্যিদ।
৪ সহপাঠী নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ গঠন করেন। প্রথমে রাকসু’র সাহিত্য সম্পাদক ও পরের বার ভিপি নির্বাচিত হন। অবশ্য এর আগেই রাজনীতির দীক্ষাটা পেয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের কাছে। ঢাকার এক অনুষ্ঠানে দেখা পান রাজনীতির রহস্যপুরুষ খ্যাত সিরাজুল আলম খানের। মুক্তির মন্ত্রটা পেয়েছিলেন প্রথম তাঁর কাছে।
’৬৪ সালে দেখা পান স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর। পাকিস্তান আর্মির গুলিতে আহত তৎকালীন এমএনএ হোসাইন মনসুরকে দেখতে রাজশাহী এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। তাই আমাদের সামনে স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
পাকিস্তান শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে কিছুদিনের মধ্যে ফের রাজশাহী আসেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে উঠলে পাকিস্তানপন্থিরা মাইক ভেঙে দিতে উদ্যত হন, বক্তব্যে বাধা দেন। তখন বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠেন, বলেন আমার চেয়ে বড় গুণ্ডা কে আছ? এসময় শাহ মগদুম মাজারের পাশে আনসার আলী নামের এক স্বীকৃত গুণ্ডা ছিল। তার ছিল বিশাল বাহিনী। আবু সাইয়্যিদ ছুটে যান তার কাছে। বলেন, জলদি আপনার বাহিনীর কিছু লোক দরকার। তিনি বললেন, ৩০ টাকার মদ কিনে দাও। দিলেন কিনে। দ্রুত আনসার বাহিনীর লোক পৌঁছে গেল ঘটনাস্থলে। এরপর পুরো অনুষ্ঠান দখল করে নেয় বঙ্গবন্ধুপন্থিরা। সেদিন রাত ১১টা পর্যন্ত বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার আপদ, বিপদ, মুসিবত।’
অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ বলেন, ‘১৯৬৯ সালে ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে, পাকিস্তান আর্মির গুলিতে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সামশুজ্জোহা। এই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু ছুটে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। তারও আগে যোগ দিই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক হিসেবে। বঙ্গবন্ধু এবার আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করলেন। বললেন, তোকে রাজনীতির হাল ধরতে হবে। বললাম, আমি তো পিএইচডি করছি। বঙ্গবন্ধু শুনলেন না কোনো কথা। বলেন, যা বলছি তাই কর। দেশ স্বাধীনের পর পিএইচডি করতে পারবি। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এসময় রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আমাকে বক্তৃতা দিতে বলেন। কিন্তু কিছু লোক আমাকে বক্তৃতার সুযোগ দিতে চান না। বঙ্গবন্ধু বললেন, অবশ্যই সাইয়্যিদ বক্তৃতা দেবে এবং সেটি আমার কোটায়। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে বক্তৃতা করলাম। সবার বাহবা পেলাম। বঙ্গবন্ধু ‘সাবাস’ বলে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন।’
আসে ’৭০ এর নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর প্রার্থী অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ। সেই নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন আবু সাইয়্যিদ। বলেন, ’৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে মনোনয়নই শুধু দেননি, নির্বাচনের জন্য ৩ হাজার টাকা এবং পোস্টার ছাপিয়ে পাঠালেন। নির্বাচনের তিনদিন আগে আমার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও কৌশল নিয়ে টেলিফোনে কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফোনালাপই ছিল আমার জীবনের প্রথম টেলিফোন আলাপ। বলেন অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ।
অধ্যাপক সাইয়্যিদ বলেন, ’৭০ এর নির্বাচনী প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বগুড়া যাচ্ছিলাম। রাস্তায় সারি সারি গরুর পাল দেখে বঙ্গবন্ধু আমার কাছে একটি ডেইরি ফার্ম করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ’৭০ এর নির্বাচনে ২৭ বছর বয়সে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে গেলাম। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে বৈঠক হয় তাতে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। পলে পলে বঙ্গবন্ধুর স্নেহ মমতায় আমি হয়ে উঠি দুরন্ত, দুর্বার।
বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার আরেকটি স্মারক তুলে ধরেন আবু সাইয়্যিদ। বলেন, ’৭৩ এর নির্বাচনে পাবনা জেলা কমিটি থেকে মনোনয়নের জন্য যে তালিকা পাঠানো হয় সেখানে আমার নাম না দেখে বিস্মিত হন বঙ্গবন্ধু। পরে পাঠানো তালিকা বাদ দিয়ে আমাকেই এমপি পদের জন্য মনোনীত করে বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিলেন আমার প্রতি তার ভালোবাসার ব্যাপ্তি কতটা। সেই নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হই।
অধ্যাপক সাইয়্যিদ এবার স্মৃতি হাতড়ে নিয়ে যান ’৭১ এর উত্তাল মার্চে। বলেন, ১৯৭১ এর ৪ মার্চ পল্টনের জনসভায় ছাত্রলীগের চার খলিফা আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাকে বেশি বুঝাইও না। কোন পরিস্থিতিতে, কখন কী করতে হবে আমার জানা আছে। ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
তারও আগে ১৯৭০ সালে একান্ত আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়েছিলেন আবু সাইয়্যিদকে। বলেন, আমরা নির্বাচনে জিতব। আমাদের ক্ষমতা দেওয়া হবে না। আমরা মানব না। আমাদের উপর পাকবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হবে। আমরা যুদ্ধ করবো। দেশ স্বাধীন হবে।
১১ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফের দেখা আবু সাইয়্যিদের। বঙ্গবন্ধু এলাকায় এলাকায় জনমত গঠন করতে নির্দেশ দেন, বলেন দেশকে স্বাধীন করতে হবে। এরপর এলাকা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনমত গঠনে নেমে পড়েন সাইয়্যিদ। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর ভারত চলে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে দিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় নিয়োজিত হন এবং ৭ নং সেক্টরে প্রশিক্ষণ নেন।
ওই সময়ের স্মৃতি থেকে মতিয়া চৌধুরীর বিয়ে-বার্ষিকীর একটি কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক সাইয়্যিদ। দুঃখ করে বলেন, আমরা যখন যুদ্ধের রসদ যোগাতে ব্যস্ত, সারাদেশ যখন যুদ্ধের ডামাঢোল বাজছে, তখন আজকের কৃষিমন্ত্রী তাঁর বিয়েবার্ষিকী নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন ভারতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বিয়েবার্ষিকী উদযাপন করেন সাড়ম্বরে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা লাভ করে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটি স্পর্শ করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই মঞ্চে উঠার সৌভাগ্য হয় অধ্যাপক সাইয়্যিদেরও। ১২ জানুয়ারি একান্ত আলোচনায় সাইয়্যিদকে বঙ্গবন্ধু বলেন, কীরে তোকে না বলেছিলাম এই দেশ স্বাধীন হবে। এসময় বঙ্গবন্ধু ’৭০ এর নির্বাচিত এমপিদের প্রত্যেককে বাড়িঘর সংস্কার ও খরচের জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন। বঙ্গবন্ধুকে সাইয়্যিদ বললেন, এই টাকা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধের সময় আমার এলাকায় আড়াই হাজার ঘর পুুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে আমার নিজের ঘর সংস্কার করলে আপনার বদনাম হবে। বরং ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই হাজার পরিবারের প্রত্যেকের জন্য ৫শ টাকা এবং এক বান্ডিল টিনের ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু সাইয়্যিদের সেই কথায় খুশি হন এবং চাহিদা অনুযায়ী টিন ও টাকার ব্যবস্থা করেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু আবু সাইয়্যিদকে পাবনা জেলা ত্রাণ কমিটির চেয়ারম্যান করেন। ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধানের খসড়া কমিটির সদস্য করেন। বগুড়ায় ডেইরি ফার্ম করার ইচ্ছা মিল্ক ভিটা গঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন অধ্যাপক সাইয়্যিদকে। ডেইরি ফার্মের জন্য জ্ঞানার্জন ও প্রশিক্ষণে ভারতের গুজরাটেও পাঠান তাকে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে পাবনা জেলার গভর্নর করেন আবু সাইয়্যিদকে।
৭ আগস্ট আবু সাইয়্যিদের স্ত্রী দিলরোবার বড়ভাই ভারত গিয়ে যে হোটেলে উঠেন কাকতালীয়ভাবে সেখানে দেখা হয়ে যায় মেজর ডালিমের সঙ্গে। মেজর ডালিম সেদিন তাকে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে আমরা মেরে ফেলবো। স্ত্রীর বড়ভাইয়ের কাছে এই খবর শুনে সাইয়্যিদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে জানান। মনসুর আলী বেশ চিন্তিত হলেন। বললেন, মোশতাক নয়, তাজউদ্দিনের কমান্ডে কিছু একটা হতে পারে। কারণ তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠন তখনো মেনে নিতে পারেননি।
এর ৮ দিনের মাথায় খন্দকার মোশতাকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে খুনীচক্র। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে ভারতে আত্মগোপনে চলে যান অধ্যাপক সাইয়্যিদ। এরশাদ ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরে আসেন এবং চার চার বার মন্ত্রীর আহ্বান ফিরিয়ে দেন আবু সাইয়্যিদ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বীজ রোপিত যে হৃদয়ে সেই হৃদয় কি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে? কারণ এ হৃদয় তো বঙ্গবন্ধুর বিশালতায় ঋদ্ধ, পরিশুদ্ধ।
অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ আজ বঙ্গবন্ধুর গড়া দলে নেই। সেই দলের সরকারেও নেই তিনি। আছেন চেতনায়, জাগরণে। তাইতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৫ হাজার পৃষ্ঠার দেশের সর্ববৃহৎ কাহিনীনির্ভর বই লেখায় হাত দিয়েছেন অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ। এরই মধ্যে ১ হাজার পৃষ্ঠার কাজ শেষ করেছেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ও দেশের সমকালীন রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে ১০টি গ্রন্থ লিখেন তিনি। ওই যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হলে পিএইচডিটা করে নিতে! সেই কাজটিও করেছেন আবু সাইয়্যিদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রিটাও করে নিয়েছেন।
ধানমন্ডির ১১ নম্বরের বাসায় স্ত্রী দিলরোবার সঙ্গে জীবনের সুখ-দুঃখের মালা গেঁথে কাটে এখন অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদের সারাবেলা। তিন সন্তান আলী নাজির অনিন্দ্য, অনিম সাইয়্যিদ, আহারিতা সাইয়্যিদ থাকেন আমেরিকা-কানাডায়। তাদের কাছেই এখন অধ্যাপক সাইয়্যিদ দম্পতির ভরণ-পোষণ, জীবন-জীবিকার সমস্ত দায়ভার।