ঝিনুক নীরবে সহে যায়, হাসিতে মুক্তা ফলায়


ওমর ফারুক হিমেল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে: প্রবাসীদের দিন-ক্ষণ-বছর কাটে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে। কিন্তু ঈদের দিন এলে দুঃখ-বেদনা অনেকটাই দূর হয়ে যায়। ক্ষণিকের জন্য হলেও ঈদের আনন্দে সব রাগ, সব দাবি মুছে যায়। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার ভিন্ন ভিন্ন আমেজ, ভিন্ন স্বাদ। হাসি-আনন্দের মাঝে আছে নীরব কান্না, নীরব কষ্ট, নীরব ব্যথা। মুখ আছে, বুলিও আছে, কিন্তু বোঝাবার যেন সাধ্য নেই। রসগোল্লা কি মজা- না খেলে যেমন বুঝা যায় না, তেমনি প্রবাস সংগ্রামে না আসলে জীবনের মর্ম বুঝা যায় না। আমাদের দেশের ঈদ আনন্দ আর বিদেশে ঈদের আনন্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন।

পরবাসে আমাদের ঈদ- সকালে ঘুম থেকে উঠেই কর্মময় জীবনের প্রথম পরিচ্ছেদের আরম্ভ। প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী সকালে কাজে যোগ দিতে যাত্রা শুরু, রাতে আসা। সারাদিন জীবনযুদ্ধ, কর্মস্থলে কাটে ব্যস্ত সময়। সকালের সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়, পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। সূর্য কখন ওঠে, কখন ডোবে- জানার সেই সুযোগ নেই। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবনের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আশায় প্রবাসে জীবনের কর্মময় আদ্যোপান্ত টানতে হয়।

বিরামহীন, বিরতিহীন চলে কর্মশালার কর্মযুদ্ধ। নিজের, পরিবারের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ভবিষ্যৎ জীবনকে সৌন্দর্যময় করার জন্য এই কর্মযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আমার জীবনের ১৮টি ঈদ কোরিয়ায় কেটে গেল। আর কতো ঈদ যাবে, কে জানে। আমাদের কাছে অধরা হয়ে রয় ঈদের আনন্দ, ঈদের সৌন্দর্য। কোরিয়ায় প্রবাসের রোবটিক জীবন নিয়ে এখন আর খারাপ লাগে না।

কর্মের সাথে প্রেম, কর্মের সাথে ভালবাসা, কর্মের সাথেই বন্ধন। এই প্রবাসে কর্মকে নিয়েছি ইবাদতের মতো। কর্মই যেন জীবনগল্পের কাব্যিক উপাখ্যান। এর পরেও নিজের কৃষ্টি, নিজের সংস্কৃতি, নিজের মাটির জন্য, দেশের জন্য শূন্যতা অনুভব করি। মন কাঁদে, মন জ্বলে লাল-সবুজের জন্য। লাল সবুজে প্রথম পথচলা, এই শিকড়ে বেড়ে উঠা। সেজন্যই আনমনে খারাপ লাগে ঈদ এলেই। আবেগে আপ্লুত হই, মায়াবী মায়ার টান বাড়ে দেশে রেখে আসা মায়ের কবর, বাবা, আত্মীয়, পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধবসহ আরও আপনজনদের জন্যই।

স্বদেশে ঈদের আমেজ পুরো রমজান জুড়ে শুরু হতে থাকে। আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে সর্বত্র। ঈদুল ফিতরে রমজানের বাহারি ইফতার, ধুমধাম, ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ, মনকে উতলা করে, নস্টালজিয়ায় ভোগায়।

বেদনাসিক্ত মন থাকলেও এই মহাখুশির দিনে সব ধুয়ে-মুছে যায় অজানা ঠিকানায়। বন্ধুদের সাথে কোলাকুলি, ছোটদেরকে ঈদী দেওয়া, কতোই না খুশি, কতই না আনন্দের ছিল। প্রবাসে আধুনিকায়নের যুগে সব থাকা সত্ত্বেও খুঁজে পাওয়া যায় না সেই আনন্দ। চিরবরণীয়, চিরস্মরণীয়, চির আনন্দের এই দিনে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনছন থেকে মনে পড়ে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যর সকল প্রিয় বন্ধুদের।

প্রবাসে অর্থের মুক্তি আছে, স্বচ্ছলতার নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু আনন্দের, খুশির নিশ্চয়তা নেই। আমার দেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ। সেই রূপ দেখার সাধ প্রবাসে আর মেটে কই?

ঈদ আসে, ঈদ যায়। বিদেশ মানেই সুখের পৃথিবী, সুখের অভিনয়। ছোট ছোট অনুভূতিগুলো দহনে দহনে দগ্ধ করে।ঝিনুক নীরবে সহে, ঝিনুক নীরবে কাঁদে।