রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

গল্পে গল্পে প্রার্থনার স্বাদ ও শবে কদর

জুলফিকারের ডায়েরি

প্রকাশিতঃ ৪ জুন ২০১৯ | ১২:২৩ পূর্বাহ্ন


শেখ মোহাম্মদ জুলফিকার বিপুল : মুশু ইদানিং রিলিজিয়ন নিয়ে প্রশ্ন করে। সে শবে কদরের রাতটা নিয়ে ভাবছে। এই রাতে কি প্রার্থনা করবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন করছে।

আমি থিওলজিস্ট না, তারপরও বললাম- দেখো সবাই যার যার মতো করে প্রার্থনা করছে তুমিও করবে… কিন্তু আমার ধারণা সবচেয়ে ভাগ্যবান সে, যে প্রার্থনার স্বাদ পেতে পারে…

মুশু জানালার পাশে ইস্কন মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এইমাত্র সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় গান থামল। রাত ঠিক দশটায় এরা ঘুমিয়ে পড়ে আবার উঠে ভোর চারটায়। খুবই রেজিমেন্টেড। বলল- ওরাও প্রার্থনার স্বাদ পাচ্ছে?

নন্দনকানন মাল্টিকালচারাল, নন্দনকানন যেন মেল্টিংপট… মন্সট্রি, মস্ক, টেম্পল, চার্চ সব আছে এই এলাকাকে ঘিরে। শিশুর মনোজগতে যেটা তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটাতে পারে। সে জেনোফোবিয়া মুক্ত মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

বললাম- যে কোনও প্রার্থনা তিন রকমের হতে পারে। যেমন- তুমি শুধু মহান সৃষ্টিকর্তার গুড বুকে থাকার জন্য ইবাদত করলে। যাতে তুমি তাঁর কাছ থেকে সব ফ্যাসিলিটিজ পাও যেমন- নলেজ, ওয়েলথ, হেলথ… এতে তোমার ভুমিকাটা অনেকটা বিজনেসম্যানের মতো। তুমি একটা কাজ করছো আরো ভালো কিছু পাবার জন্য। ইউ আর ইনভেস্টিং ইওর গুড ডিডস…। আরেক রকমের প্রার্থনা হচ্ছে- আউট অফ ফিয়ার তুমি সৃষ্টিকর্তার পানিশম্যান্ট থেকে বাঁচার জন্য ভালো কাজ করলে। যাতে তুমি তাঁর শাস্তি এভয়েড করতে পারো।

বলল- এসবতো ভালো, এখানে কোনো প্রবলেম দেখছিনা।

বললাম- বলছি না এখানে কোন প্রবলেম আছে। দিজ আর গুড। কিন্তু দেখো এই দুই ক্ষেত্রে প্রার্থনার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আরো পাওয়া। একটা এক্সপেক্টেশন তৈরি হচ্ছে তোমার মনে। উনি কিন্তু কিছু জিনিস অলরেডি তোমাকে দিয়ে দিয়েছেন সেটা তুমি এড্রেস করছোনা…। বলছ- আমি ভালো কাজ করেছি এখন আমাকে ভালো কিছু দাও। না পেলে বা পেতে দেরি হলে তোমার মধ্যে একটা দুঃখের বোধ তৈরি হবে। আল্টিমেটলি তুমি সেই প্রার্থনার স্বাদটা পাবে না… চেয়ে না পেলে হতাশা আসবেই। এক্সপেক্টেশন আছে তো দুঃখ আছে…

মুশু- তাতো ঠিকই। এই যে এতো করে বলার পরও তুমি যে আমাকে আলাদিন মুভিটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছো না। আই ফিল স্যাড…

বললাম- তাহলে চলো এখন তোমাকে বলি প্রেয়ারের তিন নাম্বার তরিকাটা- দ্যা হাইয়ার লেভেল অব প্রেয়ার। শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা হচ্ছে যেখানে তুমি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করছো কেবলমাত্র তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে। কোন চাওয়া নয়, কোন অভিযোগ নয়, কোন বিজনেসের মতো করে প্রাপ্তি নয়… তখনই কেবল তুমি প্রার্থনার স্বাদ পেতে পারো।

মুশু- কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো?

-যেমন ধরো, অসাধারণ কত কিছু উনি তোমাকে দিয়েছেন। তুমি বাবা-মা, ভাই বোন পেয়েছো, পাঠানটুলিতে তোমার হাজারের মতো ফ্যামিলি মেম্বার পেয়েছো। আর দেখো ওই যে ডিসি হিলের ফুটপাতে তোমারই বয়সী ওই বাচ্চাটা যে রাতে রাস্তায় ঘুমায়। আর তুমি ভালো পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছো। গুড ফুড, লেগো, পাজল্‌ পাচ্ছো… এই যে আমি তোমার সাথে এতক্ষন বসে গল্প করছি এসব কোনটাই গ্রেন্টেড না। এসব তোমার প্রিভিলিজ। এখন এই প্রাপ্তিগুলোর কথা চিন্তা করে তুমি যদি প্রার্থনা করো সেটা হবে জোস!

আবার দেখো এই সব কিছু বাদ দিয়ে তুমি নাশুকরিয়াও করতে পারো। যেমন তুমি ভাবলে- বাবা আমাকে এখনো ডিজনিলেন্ডে নিয়ে যায়নি, মুভ এন পিক আইস্ক্রিমের একটা আস্ত দোকান কিনে দেয়নি, স্মার্ট ফোনে এত ফান থাকার পরও দেয়নি… এরকম হাজারো না পাওয়া নিয়ে তুমি মিজারেবল হতে পারো।

মুশু- আই সি!

-দেখো, আগের দুই লেভেলও ওকে। তবে অনেক বেশি রুডিমেন্টারি। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইতে হবে, তাঁকে ভয় পেতে হবে। কিন্তু ওই দুই ক্ষেত্রের বেলায় ইবাদতের স্বাদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সমূহ সম্ভাবনা আছে যে ভবিষ্যতে ওরশিপ ছেড়ে দেয়ার…

মুশু- তাইতো দেখছি…
-ওকে, মাথায় আর চাপ নিও না।
-কই মাথায়তো চাপ পড়ছে না…

বললাম- তাহলে আসল কথায় আসো। এতক্ষণ আমি তোমাকে যা বললাম এগুলো কোনটাই আমার কথা না। এগুলো অসাধারণ একজন মানুষের কথা, যাঁর নাম হযরত আলী (রাঃ)। তুমি টেবিলে রাখা আমার আনা নতুন বইটা নিয়ে আসো। সেখান থেকে তোমাকে উনার কোটটা পড়ে শুনাই। বইটার নাম ‘হযরত আলী’ লেখক আবুল ফজল।

মুশু দৌড়ে বইটা আনতে গেলো…

বললাম- দেখো ১৭৯ পেইজে, হযরত আলী (রাঃ) এর কথামালার মাঝে ৬৯০ নাম্বারটা পড়-

সে শব্দ করে পড়ছে… হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন-“ যারা স্রেফ আল্লাহ্‌র রহমত পাওয়ার জন্যই আল্লাহ্‌র ইবাদত করে, তারা বণিকের মতই আল্লাহ্‌র সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। যারা আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে বাঁচবার জন্যই আল্লাহ্‌র ইবাদত করে, তারা স্রেফ ক্রীতদাস। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও এমন লোকও আছে- যারা কৃতজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আল্লাহ্‌র ইবাদত করে – এরা ভদ্র ও শরীফ লোক।”

বললাম- মজাটা হলো একেবারে নেচারাল ল’অব এট্রাকশন হচ্ছে কৃতজ্ঞ মানুষ সব কিছুকেই আকর্ষণ করে যা সে চায়।

তাই চলো এবারের শবে কদরে আমরা প্রার্থনার স্বাদ নিতে চেষ্টা করি…