সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : যত বদলায়, ততটা আসলে বদলায় না। এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে মানুষের মনে একটা বড় বিশ্বাস এই যে, রাজনীতি করা সব একই রকমের হন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মন্ত্রীসভা পুনর্বিন্যাস একটি রুটিন কাজ। মন্ত্রীসভায় নতুন গতি আনতে, কাজে বলিষ্ঠতা আনতে প্রধানমন্ত্রীকে এটা করতে হয়। তবে গত বছর ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নতুন সরকার গঠনের পর যে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে তা পুনর্বিন্যাস নয়, একেবারে বিন্যাস।
নতুন মুখ অনেকেই আছেন মন্ত্রীসভায়, পুরোনো অনেকে ফিরেছেন, তবে তাদের আগের মন্ত্রণালয়ে নয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফিরেছেন শিক্ষায়, আর সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পেয়েছেন তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব।
নির্বাচনের পর নতুন সরকার মানেই দেশময় সরকারের শাসন-যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বিরোধীরা ছুরি শানাবে, সুশীল সমাজ দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে নানা কথা বলে মাঠ-ময়দান মুখরিত করে রাখবে।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমন একটি কঠিন সময় দায়িত্ব নিয়েছেন যখন বাংলাদেশের গণমাধ্যম বড় চ্যালেঞ্জ আর সমস্যায় নিপতিত। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বেশিরভাগই রুগ্ন। আর্থিক দৈন্যতায় একটি চ্যানেল তার বার্তা বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে, একটি চ্যানেল তার বার্তাবিভাগ সংকুচিত করতে অর্ধ শতাধিক কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছে। পুরোনো সমৃদ্ধ চ্যানেল পাঁচমাসেরও বেশি সময় ধরে বেতন দিতে পারছে না। পূর্ণবেকার আর অর্ধবেকারে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের টেলিভিশন ভুবন। দৈনিক পত্রিকাগুলোরও অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে বাজারে টিকে থাকতে। আর আনলাইন এ যুগের বাস্তবতা হলেও এই খাতের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি এখনও দূরের কল্পনা।
মাত্র পাঁচ মাসের সময়ে ড. হাছান মাহমুদ একটি বার্তা মিডিয়া জগতকে দিতে পেরেছেন যে, তিনি তাঁর কাজের ভুবনে প্রকৃত ও বলিষ্ঠ সংস্কার চান। তাইতো একদম শুরুতেই তিনি যা করেছেন, তাঁর পূর্বসুরিরা বিগত দশ বছরে তা করেননি। আমাদের টেলিভিশন জগত বিজ্ঞাপননির্ভর। সেই বিজ্ঞাপন বাজার সংকুচিত হতে হতে শীর্ণ হতে চলেছে। এর একটি বড় কারণ আমাদের দেশীয় বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলে চলে যাওয়া। মানুষ দেশে বসে বিদেশী চ্যানেল দেখার পাশাপাশি দেশীয় বিজ্ঞাপনও দেখছে সেইসব পরদেশী চ্যানেলে, যা বাংলাদেশের ক্যাবল টেলিভিশন পরিচালনা আইন ২০০৬-এর সুস্পষ্ট লংঘন।
এই আইন অনুযায়ী সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশেও বিদেশী চ্যানেল বিজ্ঞাপনবিহীন ক্লিন ফিডে সম্প্রচার করতে বাধ্য। অর্থাৎ বিদেশী চ্যানেল এদেশে দেখাতে হলে বিজ্ঞাপন কর্তন করেই দেখাতে হবে। এই আইনটি গত তের বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ২০১৬ সালে গণমাধ্যমের মালিক, কর্মী, এ জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট অভিনয়শিল্পী, নাট্যনির্মাতা, লেখক, প্রযোজক, কারিগরি কর্মীরা মিলে মিডিয়া ইউনিটি গঠন করে বিদেশী চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীকে ডেকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলেন।
কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এবার নির্বাচনের পর বিষয়টি প্রথম বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মাধ্যমে সরকারের নজরে আনে সম্প্রচারকর্মীদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার। একটি সেমিনারের মাধ্যমে টেলিভিশন খাতের সমস্যার কথা তাঁর সামনে তুলে ধরা হয়। সেই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলাম আমি। তিনি পুরো সময়টি ছিলেন, সময় নিয়ে সাংবাদিক, সম্পাদক, ক্যাবল অপারেটর, ডিস্ট্রিবিউটর ও বিজ্ঞাপন জগতের প্রতিনিধিদের কথা শুনেছেন। এরপর তাঁর সাথে কথা বলেছেন টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন এটকো। সময় না নিয়েই তিনি মন্ত্রণালয় থেকে ডিস্ট্রিবিউটরদের কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছেন, কেন বাংলাদেশে ক্লিনফিডে বিদেশি চ্যানেল দেখানো হচ্ছে না। অতি অল্পসময়ে এই নোটিশটি মন্ত্রণালয় থেকে আসায় আমরা আশাবাদী যে এবার একটা কিছু হবে। গত দশ বছরে একটা নোটিশও জারি করা সম্ভব হয়নি মন্ত্রণালয় থেকে। একই সাথে ডিজিটাল প্লাটফর্ম যথা ফেসবুক ও ইউটিউবে যেভাবে দেশি বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে সেটিও তাঁর নজরে এসেছে। তিনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সামনে বড় আরেকটি কাজ অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের নীতিমালা চূড়ান্ত করা। প্রায় দশবছর আগে এটি চূড়ান্ত হয়, কিন্তু তার বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ বা উদ্যম এতদিন চোখে পড়েনি। আমরা এখন দেখছি সেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী (চাকরি শর্তাবলী) আইন ও সম্প্রচার আইনের দুটি খসড়া আইন এখন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং-এর অপেক্ষায়। আমরা আশা করছি তিনি এ দুটি আইনপাশের ব্যবস্থা করবেন। আর সংবাদপত্রের জন্য নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের উদ্যোগও নিবেন।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ একইসাথে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। তিনি রাজনৈতিক নেতা। কোনো মন্ত্রী যদি অকর্মণ্য হন, তবে তাঁকে বাদ দেয়াই শাসন প্রণালীকে পরিশুদ্ধ করার শ্রেষ্ঠ পন্থা, অন্য মন্ত্রকে তাঁকে বদলি করা নয়। সে দিক থেকে বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী ঠিক কাজই করেছেন, অন্তত তথ্য মন্ত্রণালয়ের বেলায়। এই মন্ত্রকে অনেকদিন পর নতুন মুখ, নতুন এনার্জি।
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের বা ব্যাক্তির কাজ কী? দেশের মানুষের চাহিদা-আকাক্সক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করে তার রূপায়ণের প্রচেষ্টাই দলের কাজ, নেতৃত্বের কাজ। একেই বলে গণতন্ত্রের তত্ত্ব। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা হয়ে পড়েন আত্মকেন্দ্রিক বা কোনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। নাগরিক বা আর্থ-সামাজিক চাহিদা সমূহে তাচ্ছিল্য করাই যেন এদেশে মন্ত্রীদের কাজ হয়ে উঠেছিল। কী করলে দেশের উন্নয়ন হয়, নাগরিক অধিকার এবং জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হয়, সেইপ্রশ্নগুলি আর তাদের মননে থাকে না।
সে বিবেচনায় তথ্যমন্ত্রী এখন পর্যন্ত নিজেকে ব্যতিক্রম প্রমাণ করেছেন। সমস্যা বুঝতে চেয়েছেন, সমাধানের পথ খুঁজেছেন, উদ্যমী হয়ে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের, পছন্দের ব্যক্তিদের অমাত্য নিয়োগ করার এখতিয়ার ও বিশেষাধিকার একান্তভাবে প্রধানমন্ত্রীরই। নতুন সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনে তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে তা সময়ই বলবে। তবে তথ্যমন্ত্রী এখন পর্যন্ত মর্নিং শোজ দ্যা ডে’র তত্ত্বে ইতিবাচক স্তরেই আছেন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।