শেখ মোহাম্মদ জুলফিকার বিপুল : আমার প্রথম বৃদ্ধাশ্রম দেখার সুযোগ হয়েছিল আমেরিকায়, ওকলাহোমা য়ুনির্ভারসিটি থেকে একটা ক্লাসের অংশ হিসেবে সেখানে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্যটা ছিল ওই হোমের বাসিন্দাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো। আমার মনোজগতে সেটা খুবই স্ট্রাইক করেছিল। বৃদ্ধদের জন্য এরকম কিছু থাকতে পারে যেটা ছিল আমার কাছে একেবারে নতুন।
তখন আমার কাছে বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে আমার দাদা-দাদি, আর কুমিরায় আমার নানি। ৭০/৮০ বছর বয়সেও পাঠানটুলিতে বা কুমিরার বাড়িতে দেখতাম তাঁদের দাপট। তাঁদের ঘিরেই যেন ছিল সব ঈদ, উৎসব, গেট টুগেদ্যার।
আর ওকলাহোমার ওই ওল্ডহোমে গিয়ে দেখলাম দিনের পর দিন পরিবার-বিচ্ছিন্ন একদল সিনিয়র সিটিজেন কীভাবে দিন কাটায়!
একজনের কথা আমার মনে আছে যিনি ছিলেন যুদ্ধফেরৎ ইউএস আমির এক্স অফিসার। তিনি আমাকে বলেছিলেন শেষ কবে তার ছেলে মেয়েদের সাথে দেখা করেছেন মনে পড়ছে না। তারা কোথায় থাকেন জানেন না, লাস্ট তার মেয়ের সাথে যখন কথা হয় তখন সে ম্যামফিসে ছিল…।
কিন্তু ভদ্রলোকের তার ছেলেমেয়েদের প্রতি কোনো রাগ বা ক্ষোভ ছিল না। তিনি বলেছিলেন- আমি সারাজীবন আমার প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, আমি গ্রেট সোলজার হতে চেয়েছি, আমার সন্তানদের সাথে আমার তেমন পরিচয়ই ছিল না, আমি কেবল তাদের বায়োলজিক্যাল ফাদারই ছিলাম। তারপর, দেয়ালে ঝুলানো পুরনো আর্মির ইউনিফর্মটা দেখিয়ে বলেছিলেন- দেখো আমার কত কত ব্যাজ, কিন্তু রাত যখন গভীর হয় আমি চাই কেউ আমার সাথে কথা বলুক, তখন আমার এতসব সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট এসব এচিভমেন্ট আমার সাথে কথা বলে না… শুনেছি আমার দু’জন গ্র্যান্ড চিল্ড্রেন হয়েছে, তারা যদি আমার কাছে থাকতো হয়তো আমার সাথে অনেক কথা বলতো, আসলে এগুলো হচ্ছে আমার কর্মফল।
এই হচ্ছে ক্যাপিটালিস্ট আর কর্পোরেট আমেরিকার ডার্ক সাইড। মোমবাতির ঝলমলে আলোর নিচে অন্ধকারের মতো। বাংলাদেশেও কর্পোরেট কালচার বুম করার সাথে সাথে বৃদ্ধাশ্রম বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।
ওই সোলজারের ঘটনা আমাকে দেখালো, বাবা মাকে পরিত্যাগ করা বা ওল্ডহোমে রেখে আসার বিভিন্ন ঘটনায়, একতরফা আমরা যে কেবল সন্তানদের দোষারোপ করি তার আরেকটা উল্টোচিত্রও আছে। শৈশব থেকেই যদি সন্তানদের সাথে বন্ড তৈরি না হয়। তাদের উপযুক্ত লার্নিং দেয়া না যায়, সে সন্তানরাও মা-বাবাকে মিস না করেই বড় হতে থাকে। বৃদ্ধ বাবা-মা তাই তাদের কাছে বোঝা হিসেবেই থাকবে। শৈশবে এই বাবা-মা হয়তো তাদের কোন মানবিক শিক্ষা দেয়ার বা ধর্মের চমৎকার সব অমিয় বাণী শোনানোরও সময় পায়নি।আমরা একদিকে ভাগ্যবান। কারণ কর্পোরেট পশ্চিমের জঞ্জাল দেখে ফেলার সুযোগ পাচ্ছি, জেনে যাচ্ছি তাদের ডার্ক সাইড। অন্যদিকে আমাদের সুযোগ আছে প‚র্বের ভ্যালুজের সাথে পশ্চিমের কর্মযোগ একত্র করার। ঠেকে না শিখে দেখে শিখে ফেলার লাভ অনেক।
এতে ভালোবাসার-‘লাভ’ আর প্রফিটের ‘লাভ’ দুটোই থাকে।