গনগনে সেই সূর্যটার অপেক্ষা…

শাহানা ইয়াসমিন : জানতাম, সততার রয়েছে অনেক শক্তি, তেজ আর আগুনের মত টকটকে ঝলসানো অবয়ব। মিথ্যাচারের রয়েছে দুর্বলতা আর ভীতিময় ঘুটঘুটে আঁধার। তবুও দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বুঝি চিরকালের প্রেক্ষাপট। লড়াই করে করে, আর ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ঘূর্ণির মতন একটা আক্ষেপ দলা পাকাতে থাকে। ভণ্ডামি আর হঠকারিতায় হাঁপিয়ে ওঠা চারপাশ। ঝুঁড়িটায় এমনই ছিদ্র, একটা বন্ধ করলে তৎক্ষণাৎ আরেকটা গজায়।

উৎকোচ/উপঢৌকন/ঘুষ/বাড়তি/উপরি/উপহার/কিছুমিছু- এমনই নানা নামে প্রচলিত রীতি নামক ব্যাধি নিয়ে সমাজটাকে ছিন্নভিন্ন করে খাচ্ছে বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিত্বরা। যার সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না শোষিতরা। একসময় হয়ত রাখঢাক করে চলত এসব। এখন খোলা আকাশের নিচে, নীল বিষে নির্লজ্জতার অট্টহাসি হাসে।

সরল পথ আঁধারে যায় বেঁকে। হয়ে যায় দুর্গম। স্বার্থপরতার ভেজাল মেশানো মানুষগুলো একসময় ভয়ংকর হয়ে ওঠে। যেন নিশ্চিহ্ন করেই তবে ক্ষান্ত হবে। অসৎ পথে উপার্জনে লজ্জাহীনতা এতটাই সমাজের শিরা-উপশিরায় গাঁট বেঁধেছে আর এমনই স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে যে, এর কোনো প্রকার ব্যতিক্রম খাপছাড়া লাগে।

চারপাশে যুবসমাজ কখনো কখনো সর্বোচ্চ শৃঙ্গচ‚ড়া ছুঁয়ে চমকে দিতে পারে বিশ্ব। আবার যুবরা নেশার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফুসফুসকে জর্জরিত করে কালো থাবায় চারপাশে আনে গ্রহণ, করে নানা ধরনের অপরাধ। অবশ্য অপরাধ প্রবণতায় ধর্মের লেবাসধারী ব্যক্তি, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশার যুব বয়স্করাও কলুষিত করতে পিছিয়ে নেই। দেখেছি পথশিশুদের পলিথিনের হলুদে চোখ বুজে নিঃশ্বাসকে মরণকামড়ে ঝাঁঝরা করতে। বাতাসে পোঁড়া লাসের গন্ধ, শ্লীলতাহানির গল্পগুলো আয়নায় নিজেকে দেখবার সাবলীলতা হারায়।

আজ যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার মা-বাবা পরিজনের মাঝে বেড়ে ওঠার স্রোতে নির্লোভ ধবধবে একটা পরিমণ্ডল চাই। তারপর শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক তার মগজে-মননে বপন করতে পারে ধনাত্মক বিষয়গুলো। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহার সমাজ বন্ধু তাকে ঠেলে দিতে পারে নেতিবাচক কারাগারে।

অনেক বছর আগে, ব্যবসায় শিক্ষাপাঠ্যক্রমে নৈতিকতা আর ম‚ল্যবোধ সংযুক্ত করে সিলেবাসে পরিমার্জন করা হয়। তবে এর আগে শিক্ষকদের নিয়ে এ বিষয়ে পরিচালিত সেমিনারে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল আমার। অনেক মনোযোগ দিয়ে সেমিনার সম্পন্ন করে একাদশ শ্রেণীর ক্লাশে বিপুল আগ্রহ আর সাধনায় বুঝালাম নৈতিকতা ও মূল্যবোধের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো। বিশেষ করে খাবারে ভেজাল মেশানোর কুফল। আপ্রাণ চেষ্টায় একবস্তা লেকচার ঝেড়ে অনেক আবেগ নিয়ে উন্মুখ সবাইকে শেখালাম। নিজে নিজেই ভাবতে শুরু করলাম, এই বুঝি মানুষ গড়ে মস্তবড় কারিগর বনে গেলাম।

তারপর যথারীতি প্রশ্ন করলাম, ‘এবার বলো, তোমরা কি খাবারে ভেজাল মেশাবে?’ ওরা এক সেকেন্ড দেরি না করে সমস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ’। আমি বোবা হয়ে গেলাম। মনে হল, ডুবে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি অতলে। অক্সিজেনের অভাব। আমার সামনে যারা বসেছিল তাদের প্রায় সবাই বড় বড় ব্যাবসায়ীর সন্তান, ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি।

আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা আমাকে সেদিন বলেছিল, ‘ম্যাম, আমি যদি ভেজাল না মেশাই, তাহলে তো ব্যবসায় টিকে থাকতে পারব না।’ আমি হোঁচট খেলাম। কিছুক্ষণ নীরব। একজন মিনমিনে গলায় বলে উঠল, ‘ম্যাম আমি একটু কম ভেজাল দিব।’ আরেকজন বলল, ‘আমিও।’ এভাবে আমিও আমিও।

আসলে আমার অবস্থা দেখে সেদিন ওদের মায়া হয়েছিল। তাই ওরা আমাকে সান্তনা দেবার জন্যেই অমন করে বলেছিল।
অনেককাল পর আজ চারপাশে অরক্ষিত নৈতিকতা আর ম‚ল্যবোধের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে ওদের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। কেমন আছে ওরা, আর ওদের ভেতরে সেদিন গেঁথে দেয়া নড়বড়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধের গাছটা। ওরা কি কম ভেজাল মেশায়? সবুজের মাঝে লাল টকটকে রক্ত যেন ক্রমশ তাজা হয়ে উঠছে, ঝরে পড়ছে। রক্তাক্ত আঁকাবাঁকা রেখায় ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ। দূর থেকে ভেসে আসে চিরচেনা সেই বজ্রকণ্ঠ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

ঢলেপড়া দিগন্ত রেখা ছুঁয়ে চলে অপেক্ষার প্রহর, গনগনে সেই সূর্যটার।

লেখক : প্রভাষক, ওমরগণি এমইএস কলেজ।