শাহানা তুহিন : সকালে ঘুম ভাঙবার পর তুমুল বৃষ্টির অঝোর ধারার শব্দ, প্রচণ্ড ভালোলাগার একটা ব্যাপার। ভুলে যাই চাওয়া পাওয়ার ব্যবধানের হিসেব। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইছে না। তবুও উঠে পড়লাম। বেড়িয়ে পড়লাম। আজ কেন যেন ভাললাগার সাথে কেমন সূক্ষ্ণ একটা অস্থিরতা কামড় দিচ্ছে। একটা খচখচানি, মাছি তাড়ানোর মত উড়িয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু রয়েই গেল।
রাস্তায় কোথাও কোথাও পানি জমেছে। একটা রিকশা আসতেই, কিছু না বলে উঠে বসলাম। আজ নীতুর দেয়া পাঞ্জাবীটা পড়েছি। অনেক যত্ন করে তুলে রাখা ছিল। ভাবতেই অবাক লাগে, আজ নীতু অন্যের পাঞ্জাবী পরিপাটি করে রাখে। ছেঁড়া বোতাম অনেক যত্নে লাগায়। আসলে জীবনের কিছু দৃশ্যপট না চাইতেও বদলে যায়, অনায়াসেই। তাই আর হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি না। একসময় জীবনটাকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেছি, এখন জীবন আমাকে..।
আজ ঠিক করেছি সুখী হবো। হালকা মেজাজে রিকশাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। পরিচয়, ভাব-বিনিময়, তারপর আরো কত যে কথা।জানলাম তার নাম সাগর। আশ্চর্য, একজন রিকশাওয়ালার এমন নায়ক মার্কা নাম, ভালোইতো। হঠাৎ একসময় তার একটা প্রশ্নে আমি চমকে গেলাম। তখন তার দিকে বেশ ভালো করে তাকালাম। বয়সে আমার কিছুটা ছোট। পরনে জিন্স, যা অনেক পুরোনো বোঝা যায়, পরনে লেবু কালারের ক্যাটক্যাটে একটা গেঞ্জি, রংজলা। উস্কখুস্ক চুল, শ্যামলা একটা চেহারা, যেখানে একটা হাসি। আর এই হাসির কারণে অনেকের মাঝে আলাদা করে চেনা যায় তাকে। তার হঠাৎ ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নটা ছিল, “ভাইজান, আপনে কোনদিন ছ্যাকা খাইছেন?”
কিছুক্ষণ আমার মুখে কোন কথা শব্দ বেরোল না। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আর তার কন্ঠে কিছু একটা ছিল যার কারণে হেসে উড়িয়ে দিতেও পারলাম না। বললাম, কেন বলো তো? সে বললো, “দুনিয়াটা ধাঁধার মতন লাগে, ভাইজান। সবকিছু মনের মতন হইলে ক্ষতি কি আছিল?” শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বে কন্ঠটা ভেঙে গেল। সাগর বলে যায়, “একদিন পরীর বিয়ে হয়ে গেল। লাল টুক্যটুইক্কা জড়িদার শাড়ি, গয়না, আলতা, মেন্দি, কাজল, টিপ দিয়ে সাজছিল। আমারতো মেলা ট্যাকা নাই। অভাবের ছাঊনির ঘর। তাই বিস্তর পয়সাওয়ালার ঘরে গেল পরী”। কথাগুলো বলে সাগর কিছুটা দম নিল। আবার বলল, “জানেন ভাইজান, পরী আমারে ছাইড়া যাইবার সময় শেষ কি কতাগুলান কইছিল?- খিদার জ্বালা আর সইতে পারুম না, পেট পুইরা ভাত খামু, লগে মাছ মাংস। নতুন শাড়ি পরুম। তখন ছেঁড়া কাপড়ে কেউ আর গতর দেখবার পারব না। তুমি কষ্ট পাইও না, দেখবা আস্তে আস্তে সব ভুইলা যাইবা”।
আমার বিষ্ময়ের ব্যারোমিটারের পারদ উপরে উঠতে লাগল। সাগর এরপরে যা বললো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। -“পরী অহন কত ভালা ভালা খাবার খায়, যেগুলানের নামও জানে না, দামী গয়নায় সারা শরীর মুড়াইয়া রাখে। ঠোঁটের লাল রঙ ঘইসা ঘইসা আরো লাল করে। খদ্দেররা আনন্দে উল্লাসে টাকায় ভাসাইয়া দেয়, আমার জনমদুঃখী পরীরে। একটু ভালা খাবার, ভালা কাপড়ে আমার পরী বড়লোকেগো একটা জীবনইতো চাইছিল। কিন্তু বেজন্মা কুত্তাডা আমার পরীরে নিয়া বেঁইচা দিল”।
দেখলাম সাগর কাঁদছে, আমি নিথর বোবা হয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা অস্থিরতা নিয়ে সাগর ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠল, “ভাইজান, আপনে আমার পরীরে খুঁইজা দিবেন? আমি অরে কমু, তরে আমি নিজে না খাইয়া খাওয়ামু। নিজে এক কাপড়ে থাকুম, তবুও তোরে আমি নিত্য নতুন কাপড় পিন্দামু”।
আমি তার কথার কোন উত্তর দিতে পারলাম না। তার হাতে ভাড়াটা দিয়ে, দ্রুত সাগরের নজরের বাইরে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। বুকের ভেতর ব্যথা, চোখ ভিজে যাচ্ছে। খুব হাল্কা বৃষ্টি। মন চাইছে আকাশ ভেঙে অঝোর ধারা নামুক। পৃথিবীও কাঁদুক, আমার সঙ্গী হোক। সাগরের কষ্টের কাছে, নিজের কষ্ট তুচ্ছ হয়ে গেল। আজ শিখলাম, কেমন করে ভালোবাসতে হয়। অশিক্ষিত দীনহীন পোড়া এক মানুষের কাছে। এক অদৃশ্য লজ্জা নিয়ে পৃথিবীর বুক চিঁড়ে হেঁটে চললাম। আকাশ হুড়মুড়িয়ে উঠল, ঠিক আমার বুকের ভেতরটার মতোন।
লেখক: প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম।