চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ এম মনজুর আলম বললেন, তারা (বিএনপি) আমাকে অলঙ্কার করে রাখতে পারতো। কিন্তু সেটি না করে আমাকে সহিংসতার কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আমি কি সেটা করতে পারি? আমার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ইমেজ কি তাই বলে?
সম্প্রতি একুশেপত্রিকাডটকম সম্পাদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন বিএনপি থেকে বিদায় নেওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগে নির্বাচনই শুধু বর্জন করেননি, একইসঙ্গে বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোরও ঘোষণা দেন এম মনজুর আলম। সেই থেকে ঘর আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠে তাঁর মূল ঠিকানা। মাঝে মাঝে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও রাজনীতির কোনো প্রান্তেই দেখা যায়নি তাকে।
গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন সাবেক এই মেয়র। পত্রিকায় খবর হয়- ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন।
এ প্রসঙ্গে মনজুর আলম বলেন, বিষয়টা ‘ফেরা’ না ‘ফেরা’ নয়। বঙ্গবন্ধু আমার আদর্শিক নেতা। আমার পুরো পরিবার আজন্ম আওয়ামী লীগ। আমার পরিবারের এক সদস্য এখনো সীতাকুণ্ড আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। কাজেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আত্মিক, মনোজাগতিক। কাজেই যখন যে অবস্থায় থাকি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে যাবো।
জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি বলে এমনটা মনে করছেন-প্রশ্ন করেন মনজুর। সেই প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি। বলেন-এটা আমার রুটিন ওয়ার্ক। বিএনপির ব্যানারে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও ৫ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এই কাজটা আমি নিয়মিত করেছি। ঘটা করে জাতীয় শোক দিবস পালন করেছি। মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করেছি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে করেছি, করছি।
এ নিয়ে নানাজন নানা কথা বলেছেন। কিন্তু একচুলও আমাকে নড়াতে পারেনি। কারণ আমি মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী।
’৯৪, ২০০০ ও ২০০৫ সালে পরপর তিনবার বিপুল ভোটে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১২ বার আমাকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিএনপির সমর্থনে মেয়র হয়েও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এক মুহূর্ত্বের জন্যও ছিন্ন হয়নি। বরং সম্পর্ক বর্ণিল হয়েছে। বিএনপির সমর্থনে মেয়র হওয়ার পরও আওয়ামী পরিবারের সঙ্গে ভালোবাসায় একটুও ছিড় ধরেনি।
কর্মকাণ্ড মেয়র নির্বাচিত হয়ে সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কাজে লাগিয়েছি।
তাহলে বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া হয়েছিল কী করে?
মনজুর বলেন, সে এক অন্য ইতিহাস। ২০১০ সালে মক্কা শরীফে পবিত্র হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই বিএনপির লোকজন আমাকে ধরে নিয়ে এসেছিল। তারা বললেন, আমরা কোনো যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছি না। আপনাকে বিএনপির পক্ষে মেয়র নির্বাচন করতে হবে। নিয়ে যাওয়া হলো বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। সমর্থন দিলেন। নির্বাচন করলাম। জয়ী হলাম।
নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শপথ নিলাম। নগরবাসীর গুরুদায়িত্ব পালনের শপথটি প্রিয় নেত্রীর কাছে নিতে পেরে উদ্বেলিত হই। কোনোভাবেই মনে হয়নি আমি অন্য দল সমর্থিত মেয়র। প্রধানমন্ত্রীয় অপত্য স্নেহ আর আন্তরিকতায় মনে হয়েছিল তিনি অনুগত, বিশ্বস্ত এক কর্মীকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন। শপথের পর সরকারিভাবে অপেক্ষমান সিটি করপোরেশন ও জাতীয় পতাকাখচিত গাড়ি করে গণভবন ত্যাগ করি। মেয়র হিসেবে মহিউদ্দিন চৌধুরী সাহেবকে দেয়া প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা আমার জন্য তিনি বহাল রেখেছিলেন এবং পাঁচবছর আমি সেই মর্যাদা ভোগ করি।
শপথ গ্রহণের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুইবছরসহ ১৩ মেয়াদে প্রায় তিনবছরের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নগরবাসীকে প্রকৃত সেবাদানে আত্মনিয়োগ করি। দলীয় দৃষ্টিকোণের উর্ধ্বে উঠে দলমত নির্বিশেষে নগরভবনের দ্বার খুলে দেই। কে কোন দলের, কোন মতের সেটি মোটেও বিবেচনায় না এনে সবার জন্য প্রকৃত নাগরিক সেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় অহর্নিশ সেই চেষ্টা করেছি।
সিটি করপোরেশনের একহাজার অস্থায়ী কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করি। যখন দায়িত্ব নিই, তখন সিটি করপোরেশন মাসে বেতন দিত প্রায় ৭ কোটি টাকা। আর আমি দায়িত্ব যখন হস্তান্তর করি তখন মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৯ কোটি টাকায়। হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে হোল্ডিংস-এর সংখ্যা বাড়িয়ে তা নিয়মিত আদায়ের ব্যবস্থা করি। এছাড়া এলাকাভেদে হোল্ডিংস বাড়ানো ও কমানোর ব্যবস্থা করি। ১১টি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছি। পাঁচটি স্কুলকে ডাবল শিফট করেছি। ৬টি স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করেছি। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জাইকা থেকে ১১শ’ কোটি টাকা মঞ্জুর করিয়েছি, যেসব প্রকল্প ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। দীর্ঘদিনের পাওনা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৩০ কোটি আদায় করতে সমর্থ হয়েছি।
প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও ছাড়ের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ সহযোগিতা পেয়েছি। যখনই গেছি প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফেরাননি। আমার মেয়াদে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। বরাদ্দের সময় রিভাইজ করার কথা উঠলে প্রধানমন্ত্রী শুনতেন না। বলতেন মনজুর আলমকে পুরোটা দিয়ে দাও। চট্টগ্রামে এক বক্তৃতায় আমাকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘আমারই বধূ আন বাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া’। এ থেকেই বোঝা যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে কতটা স্নেহ করতেন।
বিএনপিকে ‘গুডবাই’ জানানো প্রসঙ্গে মনজুর আলম বলেন, সেটা তেমন কিছু না। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। সেই যাওয়া সুখকর না হওয়ায় আবার ‘বাপের বাড়ি’ ফিরে এসেছি।’
বিএনপির সংসার করা হলো না কেন?
রাজনীতির নামে মাঠে-ময়দানে টানাটানি আমার পছন্দ নয়। সুষ্ঠু, সুন্দরভাবে সিটি করপোরেশন চালাবো। নগরবাসীর দৌড়গোড়ায় নিরবচ্ছিন্ন সেবা পৌঁছে দেবো-এটাই ছিল ব্রত।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য তাগাদাটা বেড়ে যায়। কিন্তু আমি যে ‘ওই’ কাজের নই, একথা বুঝাই কারে। আমি বলি- আপনারা রাজনীতি করেন, আমাকে আমার জায়গায় থাকতে দিন। আপনাদের কোনো সমস্যা হলে, যৌক্তিক কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমাকে পাবেন। পুলিশ কমিশনার, ডিসি-এসপি তখন কে না শোনে আমার কথা। কারণ আমি মেয়র, নগরের ৬০ লক্ষ মানুষের প্রতিনিধি। মূলত আমি তাদের অলঙ্কার হিসেবে থাকতে চেয়েছিলাম। তারা সেটি বুঝলেন না। যাকগে ওসব কথা।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ-বলেন এম মনজুর আলম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের প্রতি এই মানুষটির অসম্ভব দরদ আছে। সত্যিকার অর্থেই জনগণের নেতা, চট্টগ্রামবাসীর অভিভাবক তিনি। তাঁর অনুপস্থিতিতে চট্টগ্রাম এতিম, অসহায় হয়ে পড়বে। তখন চট্টগ্রামের সুখ-দুঃখ নিয়ে বুক ফুলিয়ে কথা বলার আর কেউ থাকবে না বলে মনে করেন মনজুর আলম।
বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সফল হওয়া উচিত বলে মনে করেন মনজুর আলম। তিনি বলেন, যেভাবেই হোক তিনি মেয়রের চেয়ারে বসেছেন। সেই চেয়ারে বসে নগরবাসীর জন্য কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি তিনি সেই সুযোগ কাজে লাগাবেন।
দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন সুস্পষ্ট উল্লেখ করে মনজুর আলম বলেন, বাংলাদেশ তার আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই গতিধারা অব্যাহত থাকলে সেদিন বেশি দূরে নয়, দেশের ৮০ ভাগ মানুষ একটি প্লাটফরমে চলে আসবে এবং সেই ৮০ ভাগ লোকই হবে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের অযুত শক্তি, শাণিত হাতিয়ার।