সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

মন্ত্রীর মাধ্যমে রাসূলের কাছে সালাম!

প্রকাশিতঃ ২১ মার্চ ২০১৯ | ৩:১৮ অপরাহ্ন

ফাইল ছবি

ঢাকা : ১৯ মার্চ, মঙ্গলবার। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘসময় বৈঠক শেষ হতে হতে বিকেল সাড়ে ৪টা। দুপুর থেকে অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীরা হুড়মুড় খেয়ে ঢুকলেন তথ্যমন্ত্রীর কক্ষে। সকালে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, তারপর একনেকের মিটিং, দুপুরের পর মন্ত্রণালয়ে একদফা দশনার্থী সামাল দিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে টানা মিটিং শেষে মন্ত্রীর চোখে-মুখে তখন ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট। সেই ‘ক্লান্তি’ আড়াল করেই হাসিমুখে দর্শনার্থীদের গ্রহণ করেন মন্ত্রী। একে একে শুনতে শুরু করলেন সবার কথা। হরেকরকম আবদার দর্শনার্থীদের-কারো চাকরি, কারো অর্থ, কারো অনুষ্ঠান, কারো বা দরকার অন্য সুবিধা।

পরদিন (২০ মার্চ) ওমরা পালনে সৌদি আরব যাবেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রণালয়ের গণসংযোগ কর্মকর্তাই (পিআরও) সূচনা করেন বিষয়টার। ‘মানবাধিকার খবর’ নামে এক মাসিক পত্রিকার সম্পাদকের রূদ্ধশ্বাস আহ্বান-আকুতি, স্যার-কার্ড ছাপিয়ে ফেলেছি, অনেকগুলো স্পন্সর নিয়েছি। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন। আমার পত্রিকার ৮ বছর পদার্পণে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান (২৩ মার্চ)। প্রথম অধিবেশনে আপনি প্রধান অতিথি, সমাপনী অধিবেশনে গণপূর্তমন্ত্রী প্রধান অতিথি। আপনি উপস্থিত না থাকলে আমার অনুষ্ঠানের কী হবে!

মন্ত্রী বার বার বলার চেষ্টা করেন, আমি ওমরাহ পালন করতে যাচ্ছি, ফিরবো ২৪ মার্চ। কাজেই ২৩ তারিখের অনুষ্ঠানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্যার, কিছু একটা করুন-নইলে আমার সব শেষ! ব্যক্তিটির এমন আবদারে মন্ত্রী বললেন, আপনার অনুষ্ঠানের জন্য আমি কি তবে হজে না যেতাম? স্যার, তাহলে অন্য কাউকে ঠিক করে দিন আপনার প্রতিনিধি হিসেবে। লোকটির সঙ্গে অনুরোধ জানালেন পিআরও সাহেবও। মন্ত্রী মোবাইল ফোনে ধরলেন, পিআইবি’র নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান, বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খানকে। আবেদ ভাই, একটি মাসিক পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। আয়োজকরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সম্ভব হলে তাদের অনুষ্ঠানে আপনি একটু যাবেন। মন্ত্রীর অনুরোধে সায় দিলেন আবেদ খান। বললেন, ঠিক আছে ওনাদের আসতে বলুন।

বিটিভির এক রিপোর্টার দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে দুমাস ধরে শয্যাশায়ী। স্ত্রীও অসুস্থ। তিনি এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য সম্বলিত আবেদনে তথ্যমন্ত্রীর সুপারিশ নিতে। মন্ত্রী বললেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো সংস্থা থেকেও তো বোধহয় দেয়া যায়। পিআরও বললেন, স্যার সাংবাদিক-কল্যাণ ট্রাস্ট থেকেও দেওয়া যেতে পারে। সাথে সাথে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অর্থসাহায্যের সুপারিশ লিখে দিলেন মন্ত্রী।

দায়িত্ব নেবার পর থেকেই মন্ত্রী বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান-মানোন্নয়নে সচেষ্ট, আন্তরিক। নানা বক্তৃতায়, আলোচনায় মন্ত্রীর মুখে উঠে এসেছে বিটিভিতে মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্মাণের কথা। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দিয়েছেন মন্ত্রী। বয়স্ক, হুজুর টাইপ এক ব্যক্তি আবেদন নিয়ে এলেন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার। তার দাবি আগেও এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছেন তিনি। তাই ফের অনুষ্ঠানটি শুরু করতে চান। মন্ত্রী আবেদনটি দেখেই নাকচ করলেন। বললেন, যত্রতত্র অনুষ্ঠান আর নয়। বিটিভিকে দর্শকমুখী করতে চাই। আমি কিছু লিখতে পারবো না। লোকটি বার বার অনুরোধ করছিলেন, বিটিভির ডিজিকে যেন কিছু একটা লিখে দেন। অন্তত সিন লিখে দেন। কিন্তু না, মন্ত্রী মানের ব্যাপারে আপোস করলেন না। লিখলেন না কিছুই।

সিরাজগঞ্জ কিংবা সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে বয়স্ক এক লোক এলেন অনুদানের দরখাস্ত নিয়ে। মন্ত্রী ভাবছেন, কাকে লিখবেন। পিআরওকে মার্ক করেই দিলেন। এসময় জানতে চান আওয়ামী লীগের কোনো পদে আছেন কিনা। লোকটির উত্তর-উপজেলা আওয়ামী লীগে আছেন। কোন পদ? আছি সম্পাদকীয় পদে। সম্পাদকীয় কোন পদ-জানতে চান মন্ত্রী। লোকটি এবার আমতা আমতা করছেন। মন্ত্রীর বুঝতে বাকি নেই, লোকটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। মাইন্ড করলেন মন্ত্রী। বললেন, আপনি মিথ্যা কথা বলেছেন। মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। কেন এই মিথ্যার আশ্রয় জানতে চেয়ে পিআরওকে মার্ক করা জায়গাটিতে ক্রস দিয়ে দেন মন্ত্রী। ভুল হয়েছে মর্মে দুঃখ প্রকাশের পর সেই দরখাস্তে আবার পিআরওকে মার্ক করে লোকটিকে বিদায় দেন মন্ত্রী।

মিথ্যাবাদি, ভণ্ড মানুষদের মন্ত্রীর অপছন্দ। এই ঘটনায় মন্ত্রীর মন খারাপের রেশ তখনো আছে। নেক্সট দর্শনার্থী। এবারের দর্শনার্থী যুবকটি বললেন, তারা আওয়ামী মাইন্ডেড পরিবার। তিনি প্রবাসে থাকেন। প্রবাস থেকে এসে ফটিকছড়ি গ্রামের বাড়িতে পাকা ঘর করতে গেলে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের লোকজন এসে বাধা দেন। চাঁদাও দাবি করেন। শুধু মন্ত্রীর নয়, উপস্থিত সবারই মনে হয়েছে এটি একটি খোড়া অজুহাত। মন্ত্রী বললেন- স্থানীয় এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাদের বিষয়টি জানাতে। দেখা গেলো, সাহায্য-প্রার্থনার চেয়ে যুবকটির আগ্রহ মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। অন্য এক দর্শনার্থীর হাতে নিজের স্মার্ট ফোনটি দিয়ে মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে ক্লিক করতেই মন্ত্রী থামালেন। বললেন, না চিনে, না জেনে এভাবে আমি ছবি তুলব না।

মন্ত্রী এবার পেয়ে বসেন যুবককে। বললেন, ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সেক্রেটারির নাম কী? আমতা আমতা ভাব যুবকটির? আওয়ামী পরিবারের লোক বলে জামায়াত-শিবির ঘর নির্মাণে বাধা দিচ্ছে যে যুবককে, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি-সেক্রেটারির নাম জানেন না-বিষয়টি ভাবিয়ে তুলে উপস্থিত লোকদেরও। মন্ত্রী এবার জানতে চাইলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নাম। তাও জানেন না যুবক। তুমি যে জামায়াত-শিবির নও, তার নিশ্চয়তা কী? প্রশ্ন রেখে কক্ষ থেকে যুবকটিকে বেরিয়ে যেতে বলেন মন্ত্রী। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ, বেজায় নাখোশ মন্ত্রী। পরে স্টাফদের ডেকে জানতে চান, ছেলেটাকে এখানে কে ঢুকিয়েছে, কার মাধ্যমে এলো সে। কিন্তু কেউ জানাতে পারলেন না যুবকটি কীভাবে, কার মাধ্যমে ঢুকে গেলেন।

এসময় মন্ত্রীর কক্ষজুড়ে পিনপতন নীরবতা। মন্ত্রীর মেজাজও ভালো থাকার কথা নয়। রাঙ্গুনিয়ার এলাকার হালকা গড়নের, স্যাঁতস্যাঁতে পোশাকের এক যুবক স্বজনের চাকরি সংক্রান্ত আলাপ শুরুতেই সেরে নিয়েছিলেন মন্ত্রীর সঙ্গে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে রেসপনসিবল ব্যক্তিকে তিনি ফোন করেছিলেন। ওই ব্যক্তি রেসপন্সও করেছেন। কাজেই এ নিয়ে আর ফোন করতে হবে না। তবুও এ সংক্রান্ত কাগজটা নিজ পকেটে ভরলেন মন্ত্রী। মন্ত্রীর সামনে কোণার চেয়ারে বসে থাকা যুবকটি বললেন, পদুয়া ছাত্তার সাহেবের ছেলে আকতার প্রেসক্লাবের দিকে অপেক্ষা করছেন, আপনি কি সেদিকে যাবেন? মন্ত্রী এবার স্মিত হাসলেন। বললেন, আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম? হাসলেন অন্যরাও। যুবকটি জানতে চান মন্ত্রী পার্টি অফিসে যাবেন কিনা। হ্যাঁ, সন্ধ্যায় একবার পার্টি অফিসে যাবো। কেউ দেখা করতে চাইলে সেখানে আসতে পারে।

মন্ত্রীর সামনে সরকারি দুইজন কর্মকর্তা বসে আছেন আগে থেকেই। তাদের সঙ্গে হয়তো বিশদ আলাপ। মন্ত্রী তাদের বললেন, দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা শেষ করেই আপনাদের সঙ্গে বসবো। প্রায় সব দর্শনার্থীর কথা শুনলেন, সাধ্যমতো উপকার করার চেষ্টা করেন। এক দর্শনার্থীর জন্য আইনমন্ত্রীকে ফোন দিলেন। আইনমন্ত্রী ফোনটা ধরতে না পারায় কথা আর হয়নি। তথ্যমন্ত্রী দর্শনার্থীকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন-আইনমন্ত্রীকে অবশ্যই তিনি বলবেন। তাছাড়া বিষয়টা নিয়ে হজ থেকে ফিরে তিনিই নিজেই বসবেন বলে জানান।

প্রয়োজন মিটিয়ে এবার সব দর্শনার্থী এক এক বের হচ্ছেন। ইতিমধ্যে যাদের কাজ শেষ, তারা আগেভাগেই বেরিয়ে গেছেন। শুরু থেকে বসে থাকা রাঙ্গুনিয়ার যুবকটি বের হচ্ছেন। তখনই মন্ত্রীকে অন্যরকম এক অনুরোধ করেন তিনি। বলেন, ‘রসুল-উরে আঁর উগগ্যা ছালাম পৌঁছাইয়ুন…।’ মন্ত্রী ভেবেছেন কেউ একজন তাঁর কাছে সালাম পাঠিয়েছেন। কে সালাম দিয়েছেন-জানতে চান মন্ত্রী। যুবকটি আবার বললেন, ‘রসুল-উরে আঁর উগগ্যা ছালাম পৌঁছাইয়ুন…।’ এবারও বুঝলেন না মন্ত্রী। পাশের একজন মন্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটি। বললেন, আপনি হজ করতে যাচ্ছেন, মক্কা-মদিনায় যাবেন। তাই রাসূল (স.) এর রওজা মোবারকে আপনার মাধ্যমে একটা সালাম পৌঁছাতে চান লোকটি। মূলত সেই কথাই বলতে চাইছেন তিনি। ‘ও আচ্ছা’- বলে মন্ত্রী এবার মাথা নাড়ালেন। বললেন ঠিক আছে।

বের হতে হতে এক দর্শনার্থী বললেন- আহা, তথ্যমন্ত্রীর কাছে কত অনুরোধ! অনুরোধের কত রকমফের! চাকরি দিলেন, অর্থ দিলেন। এবার রাসূলের কাছে সালামটিও পৌঁছাতে হবে তাঁকে। অন্য একজন বলে ওঠেন, সব মন্ত্রী-এমপির কাছে এতসব আবদারের সুযোগ নেই। ড. হাছান মাহমুদ সবার কথা শুনতে চেষ্টা করেন, সবসময় সাহায্যের দরজা খোলা রাখেন বলেই তাঁর কাছে অদ্ভূত সব আবদার-অধিকার। মন্ত্রী মহোদয় কীভাবে যে এত লোড নেন, ধৈর্য ধরেন আল্লাহই জানেন!

একুশে/এটি