বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১

‘আমি ব্যর্থ হতে পারি না’ ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী

প্রকাশিতঃ ৬ মে ২০১৬ | ৮:৪১ পূর্বাহ্ন

আমিনুল ইসলাম মিঠু

SPEAKER shirin sharmin chyবাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদের স্পিকার মো. আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর স্পিকারের পদটি শূন্য হয়। এরপর ৯ম সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ শিরীন শারমিন চৌধুরী ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর তিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ)’র নির্বাহী চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।

প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে তিন বছর পার করে চতুর্থ বছরে পা রাখতে যাচ্ছেন ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে স্পিকার হিসেবে গত তিন বছর সংসদ পরিচালনায় নানান অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। একুশের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে আপনি তিন বছর পার করছেন, এই তিন বছরে সংসদ পরিচালনায় আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

ড শিরিন শারমিন চৌধুরী- ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। সেটা ছিল অনন্য এক অনুভূতি। কারণ সাংবিধানিকভাবে স্পিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী ছিলেন এবং স্পিকার হিসেবেও একজন নারী নির্বাচিত হওয়া একটি যুগান্তকারী বিষয় ছিল। কিন্তু

সেই সাথে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও ছিল। যা খুবই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছি, কারণ এসব থাকাটাই স্বাভাবিক, না থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল। একটি বিষয় ছিল বয়স কম, অভিজ্ঞতার প্রশ্ন ছিল। আর মহিলা হলে যে কোনো কাজেই পারদর্শিতা বেশি দেখাতে হয়। কারণ একজন পুরুষ যখন কোনো দায়িত্বে প্রথম আসেন, তখন কোনো প্রশ্ন উঠে না। একজন পুরুষ প্রথমবারের মত দায়িত্ব পেলেন। কিন্তু যখনই একজন নারী তখন এই প্রশ্ন উঠছে। আমারও দায়িত্ব ছিল যাতে সব নারীর জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করা যায়। অথবা কোনো ধরনের ক্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতার দায়ভার যাতে নারী সমাজকে বহন করতে না হয় সে রকম একটা চাপ বা দায়িত্ববোধ নিয়ে এই পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। যেহেতু এটা প্রথমবার। যদি নারী স্পিকার হিসেবে কাজগুলো সুচারুভাবে করতে না পারি তাহলে তা সমগ্র নারী সমাজকে বহন করতে হবে। আর নিজের দায়িত্ব যাতে সুচারুভাবে পালন করতে পারি সে বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন ছিলাম।

আপনি দায়িত্ব নেয়ার পরে সংসদেও মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে কি?

ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী : ৯ম এবং ১০ম দু’টো সংসদেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নেতা ছিলেন। কাজেই যেসব মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে তা নবম সংসদের ধারাবাহিকতায় চলছে। যেমন আমাদের স্থায়ী কমিটিগুলো প্রথম অধিবেশনেই গঠন করে ফেলি। এর ফলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকা- ও তদারকি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এর আগের সংসদে পিটিশন কমিটির সভা হয়নি। আমার নেতৃত্বে এবার এই

কমিটির একটি সভা হয়েছে। আশা করি আগামীতে আরো সভা হবে।

সংসদ পরিচালনা করতে গিয়ে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন?

ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী : আমার কাছে সংসদ পরিচালনা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেজ্ঞ মনে হয়েছে। কারণ কখন কী ঘটবে তা কিন্তু আগে থেকে জানা থাকে না। আমি চেষ্টা করি স্পিকার হিসেবে একজন এমপিকে যতখানি সম্ভব কথা বলার সুযোগ দিতে। সবাইকে সময় মত সুযোগ দেয়া ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ, যা ‘আর্ট অব দ্যা ব্যালেন্স’। একই সংসদ সদস্যকেই প্রতিদিন সুযোগ দেবো নাকি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেবো। আরেকটা বিষয় হলো সংসদ একটি নিয়মনীতির ভেতর চলে। যা সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি অনুসরণ করেই সংসদ চালাতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হলে সেটাও ঠিক করতে হবে। নবম সংসদে ভাষা নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছিলাম।

এখন কোনো সংসদ সদস্য জনগণের কথা বলার জন্যই সংসদে আসেন। তিনি কী কথা বলবেন এবং ওনার কনটেন্ট অব স্পিচ কী তা স্পিকারের বিষয় না। স্পিকার শুধুমাত্র ফেসিলেটরের ভূমিকা পালন করেন, নিয়মতান্ত্রিকতা রক্ষা করেন। তবে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্যপ্রণালীবিধিতে নিষেধ আছে। কাজেই সংসদ সদস্যরা যাতে যে বিধি অনুসরণ করে বক্তব্য রাখেন আমি সেই বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করি।

বর্তমান সংসদের নির্বাচিত সদস্য শিরীন শারমিন চৌধুরী ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১/১১ সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার

কারারুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর আইনজীবী প্যানেলের সদস্য ছিলেন শিরীন শারমিন। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করলে শিরীন শারমিন ২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী কোটায় সাংসদ নির্বাচিত হন এবং সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শিরীন শারমিন চৌধুরী ১৯৬৬ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রফিকউল্যাহ চৌধুরী, মা নাইয়ার সুলতানা। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে এসএসসি এবং ১৯৮৫ সালে একই বোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে (সম্মান) এবং ১৯৯০ সালে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। দুটিতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এ ছাড়া তিনি ২০০০ সালে যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবাধিকার ও সাংবিধানিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি (পিএইচডি) নেন। শিরীন শারমিন ২০০০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল লিগ্যাল এডুকেশন উপকমিটির সদস্য এবং ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য

নির্বাচিত হন।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খাতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, সেই সাথে তালমিলিয়ে একজন ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য হতে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে কিনা-আপনার অভিমত কী?

ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী : জনগণের ভোট যে পাবেন তিনিই সংসদে আসেন। নির্বাচিত হয়ে প্রথম যারা সংসদে আসেন তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সংসদ অধিবেশন শুরুর পরপরই ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে অধিবেশন সংক্রান্ত নিয়ামাবলী শেখানো হয়।

আমি মনে করি এক্ষেত্রে যদি আমরা আরো জোর দেই তবে তারা তাদের ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।

আপনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টের নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন। তাদের কাছে আমরা কী সুফল পাবো বা আমাদের মাধ্যমে তারা কী ধরনের সুফল পাবে?

ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী : কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে ৫৪টি কমনওয়েলথ দেশের জাতীয় সংসদসহ মোট ১৮০টি দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক সংসদ রয়েছে। আমাদের পার্লামেন্ট স্বাধীনতার পর থেকেই কমনওয়েলথ পার্লামেন্টের সদস্য। এর মূল লক্ষ্য কমনওয়েলথ দেশের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষের বাস, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কমন চ্যালেঞ্জ একত্রে সংসদ সদস্য হিসেবে কীভাবে নিতে পারে। এখন তো বিশ্বায়নের যুগ, কাজেই সবকিছু একটি গ্লোবাল ফ্যামিলির মত এবং প্রত্যেকটি দেশের বিভিন্ন ইস্যু যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, তরুণ প্রজন্মের

সম্পৃক্ততাকরণে দেশগুলোর সংসদ সদস্যরা তাদের সরকারের সহযোগিতা করে কীভাবে এগিয়ে নেবে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০১৫ জাতিসংঘে যে গৃহীত হলো, সেখানে ১৯২টি রাষ্ট্র নিজ দেশে তা বাস্তবায়নে সম্মতি দিয়েছে। সেখানে সংসদ সদস্য ও সংসদগুলোর বড় ভূমিকা আছে যে সরকার কী ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে এবং কী ধরনের নীতি অনুসরণ করছে। এগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হবে কিনা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের যে কনসেপ্ট নিয়ে কথা বলছে তা এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা। সেখানে আমরা মনে করি জনগণের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা খুবই গুররুত্বপূর্ণ, যা কিন্তু অতীতে করা হয়নি।

আপনি স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর সংসদ সচিবালয়ে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?

ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী : সংসদ সচিবালয়ে আমরা একটা ডাটা সেন্টার করেছি। যাতে সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা যায়। এটির কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। আর সংসদ টেলিভিশনের আলাদা একটা স্টুডিও করেছি যা কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে। সংসদ সদস্যসহ সংসদ সচিবালয়ে আগতদের জন্য খাবারের বিষয়ে একটি উন্নতমানের ক্যান্টিন করার পদক্ষেপ নিয়েছি। এছাড়া সংসদ ভবনের নিরাপত্তায় চারপাশে বেস্টনি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সংসদের প্রবেশমুখে আগে কিছুই ছিল না, এখন সেখানে লুই আই কানের নকশাগুলো প্রদর্শন করেছি, এর মাঝে হাতেলেখা সংবিধান রাখার পরিকল্পনা রয়েছে এবং সংসদের গ্রন্থাগারটিকে সংস্কার করারও কাজ হাতে নেয়া হবে।