চট্টগ্রাম : এস এম রানা, পুরোদস্তুর সাংবাদিক। প্রতিদিন সংবাদের জন্য ঘুরতে হয় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তথ্য উদঘাটন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানা চমকপ্রদ কাহিনী। মুখোমুখি হতে হয় রোমঞ্চকর নানা অভিজ্ঞতার। ভালো-মন্দ, আলো-আঁধারের শত চিত্র প্রতিনিয়ত জমা হয় মস্তিষ্কের অনুরণনে। সেসবের সহজ-সাবলীল বর্ণনা রিপোর্ট ছেড়ে এবার ওঠে এসেছে বইয়ের পাতায়। পত্রিকার পাতায় যা বলা যায়, যা যায় না, তার সবটাকে তিনি দিয়েছেন সহজপাঠ্য রূপ। ঝরঝরে ভাষা, প্রাঞ্জল লিখনি, তাঁর লেখাকে দিয়েছে গতি। এবারের বইমেলায় সাংবাদিক এস এম রানার চারটি বই-ই এককথায় অনন্য, অনবদ্য। প্রতিটি বইয়ের আলাদা মেজাজ। পছন্দ অনুযায়ী পাঠক যেমন বেছে নিতে পারেন তাঁর বই, তেমনি ইতিহাস কিংবা তথ্য বিবেচনায়ও বইগুলো অগ্রগামী। একনজরে পরিচিত হওয়া যাক বইগুলোর সাথে।
ফেসবুকে বিপদে : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বাড়ার সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে অপ-যোগাযোগও ঘটছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ সন্ধানীরা নানাভাবে প্ররোচিত করছে মানুষকে। এরপর ব্যক্তির স্পর্শকাতর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার কেউ কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হয়েও হাতিয়ার হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করছে।
এই নিয়ে সাংবাদিক এস এম রানার নতুন বই ‘ফেসবুকে বিপদে’। এই বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে- স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গেইমস-এগুলোর সর্বাধিক ব্যবহার শিক্ষার্থীদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শুধু শিক্ষার্থীদের কথা বললে কম বলা হয়। পুরো সমাজ জীবনেই বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সমাজের প্রায় সব পেশার মানুষই কমবেশি এসবের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার। এটা প্রমাণিত সত্য। তাই শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উচিত সর্বোচ্চ সর্তকতার সঙ্গে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হওয়া। তা না হলে অনাগত ভবিষ্যতে আরো বেশি সামাজিক ক্ষয়িষ্ণুতার শিকার হতে হবে আমাদের সবাইকে। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ- কেউ বাদ যাবে না।
রোহিঙ্গা : নিপীড়িত ভূমিপুত্র : মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর থেকেই কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের দিকে দেশবাসীর নজর ছিল। আরাকানে এসব মানুষের বসতঘর পোড়ানো, গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যার মতো লোমহর্ষক তথ্যগুলো গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছিল। একপর্যায়ে টেকনাফ-উখিয়ার অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সেখানে মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসত করতে শুরু করে। সেখানকার অভুক্ত শিশুরা খাবারের সন্ধানে ছুটছিল। মিয়ানমার তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন কিংবা বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর আরো সক্রিয়ভাবে সোচ্চার হওয়া উচিত। বাংলাদেশ তো শুরু থেকেই স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করছে।
তরুণ সাংবাদিক এস এম রানা বাংলাদেশের অন্যন্য উজ্জ্বল মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের স্মৃতিচিহ্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর প্রয়াসে গ্রন্থটি লিখেছেন। তাঁর লেখনী মূলত একজন সংবাদকর্মীর দিনলিপি। দিনলিপির লেখনির মধ্য দিয়েই তিনি পাঠককে নিয়ে গেছেন রোহিঙ্গা শিবিরে এবং রোহিঙ্গাদের আদি ইতিহাসে গোড়ায়।
রোহিঙ্গাদের জন্য বাঙালি যে মততা প্রদর্শন করেছে, সেই জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নিশ্চয় বাংলাদেশের এমন মানবতার কীর্তির জন্য গর্ববোধ করবে। বিশ্বের যে কোনো দেশে গিয়ে বাংলাদেশিরা প্রশ্ন করতে পারবে, ‘মরণাপন্ন একটি জাতিকে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা ও আশ্রয় দিয়েছে কোন দেশ?’ এমন প্রশ্ন শুনে বিদেশিরা যখন হকচকিত হয়ে যাবে তখনই বুকের ছাতি ফুলিয়ে বাংলাদেশি প্রশ্নকর্তা উত্তর জানিয়ে বলবে, ‘বাংলাদেশ’। যদি এমনটা হয়, তবেই লেখক এস এম রানার এই লেখনি স্বার্থক হবে।
সংবাদের অন্দরমহল থেকে : এস এম রানা একজন সংবাদকর্মী। সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনেই নগরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে ছোটেন নিরন্তর। তাঁর লেখা কিছু সংবাদের নেপথ্যের কাহিনী লিখেছেন এই গ্রন্থে। গ্রন্থের শুরুতেই তিনি শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মফস্বল সাংবাদিকতার বাস্তব চিত্র এঁকেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, তখনকার সময়ে মফস্বল সাংবাদিকরা কতোটা পরিশ্রম করে সংবাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংবাদ তৈরি, ছবি তোলা, প্রিন্ট করা কিংবা কেন্দ্রীয় অফিসে সংবাদ প্রেরণ কতোটা ঝক্কি-ঝামেলার ছিল।
এস এম রানা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান সাংবাদিকদের একজন। কারণ তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’র প্রত্যক্ষদর্শী। অন্য সাংবাদিকরা যখন একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপত্তার কারণে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে গিয়েছিলেন, তখন এই গ্রন্থের লেখক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে জঙ্গিদের বোমা ছোড়ার দৃশ্য দেখছিলেন। বুলেটপ্রুপ জ্যাকেট ছাড়াই তিনি অপারেশন প্রত্যক্ষ করে রীতিমত দুঃসাহকিতার পরিচয় দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’র আতুরঘরের সন্ধানও বের করেছেন অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিতার মানসিকতার জোরে। গ্রন্থটি পাঠক মহলের ভালো লাগবে। সেই সঙ্গে বলা যায়, আগামীর সংবাদকর্মীদের জন্য ‘সংবাদের অন্দরমহলে’ গ্রন্থটি সুপাঠ্য হয়ে থাকবে।
নরঘাতী প্রেম : একটু সুখের আশায়, পরিবার-পরিজনকে ভালো রাখার আশায় অনেক বাংলাদেশি শ্রমজীবি প্রবাস জীবন যাপন করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে শক্ত অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত। সেই প্রবাসীদের ঘরেই কোনো কোনো সময় ঢুকে পড়ে দুর্বৃত্ত। কখনো আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে, কখনো বা গৃহশিক্ষক অথবা পারিবারিক বন্ধু পরিচয়ে।
এতে গৃহিণীরা কাবু হন বা কাবু করেন। দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়। তারপর পারিবারিক বন্ধুর ছদ্মাবরণেই শুরু হয় প্রেম প্রেম খেলা। এই খেলা চলে লুকোচক্ষুর অন্তরালে, আড়ালে আবডালে। এই খেলার দুই খেলোয়াড় বুঝেশুনেই বন্ধনহীন সম্পর্ক শুরু করেন। বলা চলে, এ ধরনের প্রেমের মূল আকর্ষণ শরীর। সামাজিক বন্ধনহীন শুধুমাত্র শারীরিক টানে তৈরি হওয়া সম্পর্কে এক সময় বিচ্ছেদ শুরু হয়। বিচ্ছেদ থেকে বিরহ বেদনা। আবার কখনো বা ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করে দানবীয় কাণ্ড শুরু করেন কেউ কেউ। যার শেষ পরিণতি দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনোখুনি।
অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক ও লেখক এস এম রানা চলমান সমাজের অপরাধ গলিতে হেঁটে হেঁটে এই উপন্যাসের ঘটনাক্রম খুঁজে বের করেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনিতে উঠে এসেছে সমাজের অন্ধকার গলির প্রকৃত অপরাধচিত্র। আমাদের সমাজে পর্দার অন্তরালে আসলে কী হচ্ছে? তা পাঠকমহল খুঁজে পাবেন এই উপন্যাসে। পাঠকমহলের কাছে হৃদয়গ্রাহী হবে এই উপন্যাস।
একুশে/এটি