:: শান্তনু চৌধুরী ::
বনানী আবহে চিনচিনে প্রেমের বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে হৃদয়। ফেব্রুয়ারি মাস, ঠান্ডা তেমন নেই। ঢাকার এমন কোনো জায়গা নেই আলম-মথুয়া ঘুরে ঘুরে ডেটিং করেনি। খোলামাঠ থেকে বড় রাস্তা, লাইব্রেরির ছাদ থেকে সিনেমা হলের চোরাকুঠুরিতে প্রেমে মজেছে তারা। অনেক সময় এমনও হয়েছে ভরা প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে চারপাশের কোনো ঘূর্ণিঝড়কেই তোয়াক্কা করে না ওরা। নয়নে নেশা লাগে। পলাশের সাথে মেতে উঠে ওরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি, মথুয়া বলছে ‘বিশ্ব কিস ডে’। ডেটে গিয়ে মথুয়া আলমকে ধরিয়ে দিচ্ছে পছন্দের ফ্লেভারের আইসক্রিম। এখন তারা যেখানে বসে আছে সেখানে জোড়ায় জোড়ায় পল্লবিত প্রেম ঠোঁট ভেজাচ্ছে চা বা উষ্ণ ক্যাপুচিনোয়। মথুয়াও অর্ডার দিয়েছে, আর আলো-আঁধারিতে ঢাকা রেস্টুরেন্টে বসে ঠোঁটের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে আলমের ঠোঁটে। রঙ লাগে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।
আলম ভাবে, মথুয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে তার টাকার অভাব আরো কেটেছে, আলমের জন্য ও খরচ করে দরাজভাবে। চাইলে পকেটও ভর্তি করে দেয়, মাঝে মাঝে গর্ব করেই বলে, ‘আমার বাবার এতো টাকা, খাবে কে?’ বাৎস্যায়ন বলেছেন, ‘ধন প্রাপ্তির জন্য কোনো নারীর সঙ্গে মৈত্রী করা খারাপ নয়, আমি ধনহীন, আমার জীবিকা নির্বাহের কোনো ব্যবস্থা নেই, অতএব ওই স্ত্রী লোকের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে আমি সহজেই ধনলাভ করতে পারবো।’ অনেক নবী-রসুলও নাকি গরীবের উপকারের জন্য এই কাজ করেছেন। কিস ডে’র পরদিন আসে ভালোবাসা দিবস। সেদিন আলম ছুটি চেয়ে নেয় জোকা সাহেবের কাছ থেকে। অবশ্য তিনি বোঝেন, তাই ছুটির কথা বলতে গেলে কান্তার দিকে চেয়ে চেয়ে মুচকি হাসেন।
ভালোবাসার দিনে আলমের খুব ইচ্ছে ছিল মথুয়াকে বাসায় নিয়ে যাবে। মথুয়ারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাদ সাধে রতন-সুজন, তাদের প্রেমিকা নাকি আসবে সেদিন। অগত্যা বাইরে বাইরে ঘোরাঘুরি। আর সন্ধ্যার ক্যাম্পাসের জন্য অপেক্ষা।
সন্ধ্যা নামতেই তারা ঢুকে পড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। খুব ভেতরে তারা যায় না, বখাটেদের ভয় থাকে। মাঝে একটি গাছ এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তাদের জন্যই অপেক্ষা। হাঁড়িকাঠের মতো ছড়ানো ডালপালা। আলমের আর তর সইছে না। কে যেন তাকে শত জনমের আবেশে ভরে দিল, ছুঁয়ে দিল। তারপর, যত ঘনিষ্ঠ হয়েছে তারা, সেই ছোঁয়া ফিরে ফিরে এসেছে আরও ঘন হয়ে। একটা শক্ত হাত, পাঞ্জার শিরশিরানি অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ বেয়ে আঙুল নামক জাদুকাঠি হয়ে বাসা বেঁধেছে মথুয়ার বুকের গভীরে। শরীরের অলি-গলি-বৃন্ত নিষ্পেষণে আদর নামের কী যেন এক গহন ছোঁয়া ক্রমশই পেয়ে বসেছিল তাকে।
এরপর বেশ কয়েকদিন দেখা হয়নি মথুয়ার সাথে। মথুয়া ব্যস্ত তার চাচাতো বোনের বিয়ে নিয়ে। এদিকে আলমও মেসের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ডিমবিক্রেতা সরোয়ার মামা বলেছে তাকে একটা ঘর ঠিক করে দেবে। মথুয়ার চাচাতো বোনের বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে আরো ভালো করে বুঝলো তারা কোন শ্রেণির ধনী। ঢাকা শহরে এমন বিয়ের দাওয়াতে সে কোনোদিন যায়নি। রাজকীয় সব আয়োজন, কতো লোক যে খাচ্ছে তার হিসেব নেই। তবে বেশিরভাগ লোকের ভাষা সে বুঝতে পারছে না। কারণ তারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। বারিধারার বিশাল ক্লাবে ঢুকেই কিছুক্ষণ থ মেরে ছিল আলম। চকিতে হাজির হয় মথুয়া। পরিচয় করিয়ে দেয় সমবয়সী ভাই-বোনদের সঙ্গে। আজ আলমও যতোটা সম্ভব নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে, কিন্তু মথুয়ার কাছে তা কিছুই নয়। ওর মোমপালিশ করা পিঠ চুঁইয়ে পড়ছে যৌন আবেদন। চুলে উঁচু করে পনিটেল করা, তাই টোনড পিঠ আরো ভালো দেখাচ্ছে। গমরঙা ত্বকের সঙ্গে মানানসই পোশাক।
কোমরের কাছে স্ট্র্যাপটা সরু তাই ফিগারটা ভেসে উঠেছে বেশি। শরীরের সেরা সম্পদ স্বাধের নিতম্ব, সেটা হাইলাইটস করতেই যেন ব্যাকলেস পোশাক। এজন্যই বুঝি মেরেলিন মনরোকে নিয়ে এতো কাড়াকাড়ি। আর হাল আমলে ম্যাডোনা নাকি বীমা করিয়েছেন এক একটি স্তনের, জেনিফার লোপেজ বীমা করিয়েছেন নিতম্বের। তার একটি গানই আছে এমন, ‘থ্রো আপ ইউর হ্যান্ডস, ইফ ইউ লাভ এ বিগ বুটি’। মথুয়া তাকে পাগল করে দিচ্ছে।
সাপ্তাহিক সদাচার অফিসে আজ সবাই আগে আগে চলে এসেছে। বিশ্ব নারী দিবসে শাহবাগ চত্ত্বরে একটা সমাবেশ আছে। প্রধান অতিথি সম্পাদক জোয়াদ্দার কামরান রইস। কান্তাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে, বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্তনকেও বেশ পুষ্ট দেখাচ্ছে। কপালে টিপ, পানি খাওয়ার উছিলায় একটু ছোট রুমে গিয়ে শাড়ি ঠিক করার ফাঁকে আলমকে স্তনও দেখিয়েছে কাপড়ের ভাঁজে।
অল্প সময়ের মধ্যে সভা পূর্ণ হয়ে যায়। বেশিরভাগই সেলাই দিদিমণিরা। গার্মেন্টস থেকে এসেছে, নিশ্চয় কিছু টাকাপয়সা দেয়া হয়েছে। মঞ্চে বিশিষ্টজনদের এক কপি করে সদাচার পত্রিকা দেয়া হয়েছে। এবারের প্রচ্ছদ করা হয়েছে নারী দিবসের, ‘সেলাই দিদিমণি’ নাম দিয়ে। কান্তা সামনের সারিতে আছে, মথুয়াকেও আসতে বলেছে আলম।
নানাজন নারীর অধিকার নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছে। ঘোষিকাও সেজেছে দারুণ সাজে। আলম-মথুয়া এককোণায় দাঁড়িয়ে আছে। মথুয়ার বিরক্ত লাগছে তা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। একপর্যায়ে আলমকে বলে ওঠে-
‘কেন তোমার এই ধরনের বোরিং প্রোগ্রামে থাকতে হবে, আমি বুঝলাম না?’
‘এখানে অনেকে পরিচিততো, তাই না
করতে পারলাম না, প্লিজ লক্ষèীসোনা, একটু থাকো।’ আলম সত্যি কথাটা বলে না। অবশ্য সে কোনো সময়েই বলেনি।
জোকা সাহেবের বক্তব্যের আগে ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ কিছু বিশেষণ যোগ করেন ঘোষিকা। তিনি যে এতো গুণের আধার বুঝতে পারে না আলম, হয়তো কান্তাও না।
‘কোথায় নিরাপদ নারীরা, না রাস্তায় না ঘরে? কোথাও না। তাই আমাদের আগে ঠিক করতে হবে আমরা কি খোলা জানালা চাই, নাকি পুরো আকাশ চাই, সামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন করবো নাকি নিজের চেনা পরিসরটুকুর অধিকার আদায় আমাদের লক্ষ্য। আমরা কি সাহসী হয়ে উঠবো নাকি নিছক ভীতু হয়ে বাস্তবের বিছানায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়বো?’ জোরে হাততালি পড়ে। জোকা সাহেব ঘাম মুছে আবারো শুরু করেন।
‘এখনকার মেয়েরা স্বামীকে এটিএম বুথ ভেবে এটা সেটা কিনছে, মাঝে মাঝে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে যাচ্ছে, কিন্তু মনের জলাশয়ে ভেসে ওঠা কটা লাইন কখনো লেখা হয়ে উঠছে না। আর যারা চাকরি করে তারা কি পারে স্বামীকে না জানিয়ে বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে। বয়ফ্রেন্ডের আনা চকলেট বান্ধবীদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়ে নিজের সৌভাগ্য নিয়ে গর্ব করছে। ‘হাবি’র আনা সারপ্রাইজ গিফট দিয়ে বন্ধুর স্ট্যাটাসের সঙ্গে তুলনা করছে। অপমানের সঙ্গে তাদের সহজাত বসবাস। এরপরও বলবো নারী দি বস।’ আবারো হাততালিতে ফেটে পড়ে জনতা।
মথুয়া আলমের দিকে ফিরে বলে, ‘লোকটা ভালোই বলছে।’ আলম হাসে, কোনো প্রতিউত্তর করে না।
বোতলজাত পানি খেয়ে আবারো শুরু করেন জোকা সাহেব।
‘কারা যেন গায়ে কাপড় রাখার দাবিতে শরীরটাই উলঙ্গ করে দেন প্রকাশ্যে। কিন্তু নিজেকে নারী ভাবার আগে ক’জন নিজেকে মানুষ ভাবতে পেরেছে? মেয়ে-শরীরকে মানুষ ভাবার মন্ত্র ক’জন ধর্ষকের মস্তিষ্কে গুঁজে দিতে পারছি আমরা? মেয়েকে সমানাধিকার দিতে পারছি ক’জন, পরিবারকে কি আমরা জোর গলায় জানাতে পারছি, রাতভর পার্টি করলে বা পুরুষ ছাড়া বাড়ির বাইরে গেলে ‘ভার্জিনিটি’ হারায় না মেয়েরা। বরং সঙ্গে থাকা পুরুষ সঙ্গীই অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।’ বক্তব্য শেষ করার আগে শেষ কথা বলে আবারো শুরু করেন তিনি-
‘মা ও বোনেরা, কিছু মনে করবেন না, এই সমাজের মেয়েরা অনেকটা বাড়ির পোষা কুকুরের মতো, লাথিঝাঁটা খেয়েও গেট খোলা পেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। সে বাড়ির কাজের বুয়া থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিসের কর্ত্রী যেই হোক না কেন। তাই আমাদের বদলাতে হবে সবার আগে, আর সেটা যদি না হয় তবে, নারী-দি-অবশ’ই হয়ে থাকবে।’ আবারো জোর তালি উঠে, মথুয়াও তালি দেয়!
‘সত্যি ভালো বলেছেন উনি’।
‘ওই যে বললেন বদলাতে হবে সেটাই কঠিন কাজ, অনেকে বাড়িতে ছেলে- মেয়েদের বাল্যশিক্ষার নীতিবাক্য পড়ান আবার তারাই অফিসে এসে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।’ মথুয়ার কথার জবাব দেয় আলম। এরই মাঝে দেখতে পায় কান্তাকে নিয়ে জোকা সাহেব গাড়িতে উঠছেন। হয়তো কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে নারী দিবস পালন করবেন। আলমও কি করে! মথুয়াকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে ঢোকে। কিন্তু মথুয়ার আসলে আর এই আলো-আঁধারি ভালো লাগছিল না। আলমকে আরো কাছে পেতে চায় ও।
এর কিছুদিন পরেই সে সুযোগ এসে গেলো, ময়না অসুস্থ হয়ে কাজে আসছে না। বাসাও ফাঁকা। খুব ভোরে মথুয়াকে নিয়ে এলো আলম। এর আগের দিন ইচ্ছে করেই রোকেয়া হলে থেকে গিয়েছিল মথুয়া। বাসায় বলেছিল, রাত জেগে নোট করতে হবে। খুব সন্তর্পণে দরজা লাগিয়ে দেয় আলম। মথুয়া আসার সময় বেশ খাবারদাবার নিয়ে এসেছে। আঙুর, চিপস আরো কতো কি! আলমের তর সইছে না। কিন্তু মথুয়ার একটু রয়েসয়ে।
‘বাবা, তোমার জন্যইতো এসেছি।’ আদরে আদরে মথুয়াকে ভরিয়ে দিতে থাকে আলম। কাপড় নিয়ে আদিমতায় মেতে ওঠার যে আনন্দ সেটা যেন আলম জানে। সবশেষ বিকিনি থেকে গেলে আলমের মনে হয়, দু’চিলতে কাপড়ের উষ্ণতায় বাঁধা পড়ে পুরুষ। সেই উষ্ণতাও কমিয়ে দিয়ে আলম বলে,
‘কী সুন্দর তোমার ত্রিভুজ’।
‘তুমি আঁকো ইচ্ছেমতোন।’ মথুয়ার উষ্ণ আহ্বান।
(শান্তনু চৌধুরী’র নারীসঙ্গ উপন্যাসের অংশবিশেষ)