রোববার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “এখন এক্সিকিউটিভ আমাদের কাছ থেকে সবগুলো ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছে।”
এই চেষ্টা রুখতে আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি।
“অতীতে আমরা দেখেছি যখনই এ ধরনের কিছু হয়েছে আইনজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন। এখন যদি বিচার বিভাগের প্রতি এক্সিকিউটিভ, আইনজীবী মহল, বিচারপ্রার্থী প্রত্যেকের আঘাত চলে আসে তাহলে বিচার বিভাগকে রক্ষা করবে কে?”
মাসদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে কাজ শুরু করে।
এরপর সাত বছরের বেশি সময় পেরোলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসেনি বলে গত বছর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় বলেছিলেন এসকে সিনহা।
বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ডিসিপ্লিনারি রুলস ও ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকার কথা বলেছিলেন তিনি।
এদিন বক্তব্যে আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন। প্রধান বিচারপতি হিসাবে আমিও সব সময় বলি। কিন্তু যদি শুধু মুখে বলি তাহলে কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যাবে?
“বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (নিশ্চিত) করতে হলে আমাদের শাসনতন্ত্রের দিক একবার বিবেচনা করতে হবে।”
দুই মাস আগে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “ভারতের প্রধান বিচারপতি আমাকে ও আমার স্ত্রীকে একটা ডিনারে আমন্ত্রণ করলেন ওনার বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম পাঁচজন বিচারক, যার মধ্যে একজন রিটায়ার্ড জাজ বাকি চারজন সিটিং জাজ।
“আমি জিজ্ঞেস করলাম, মি. ঠাকুর আপনি আমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ করলেন কিন্তু মাত্র পাঁচজন বিচারক কেন? উনি বললেন, একজন বিচারক আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। আরেকজনকে দেখিয়ে বললেন, উনি হবেন আমার পরের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি। তার পরের জন তারপরে। এভাবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যারা প্রধান বিচারপতি হবেন তাদের আমি ডেকেছি।”
এরপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এসকে সিনহা বলেন, “আমি এটা শোনার পর কেবল ওনার মুখের দিকে চেয়ে থাকলাম। আমরা কোথায়, আর ওরা কোথায়? রুল অব ল ও ইন্ডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারি বলতে কী জিনিস? এই বিচারকরা যখন বিচার করবেন এবং আমরা যখন বিচার করব তার মধ্যে পার্থক্য আর বললাম না।”
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনারাই তো সমাজের বিবেকবান, আপনাদের কাছ থেকে যদি ইন্ডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারি নিয়ে না শুনি, আপনাদের কাছ থেকে যদি শুনি শুধু অ্যান্টিসিপেটরি বেইল দেওয়ার জন্য, ওই বেইল দেওয়ার জন্য সেই বেইল দেওয়ার জন্য, তাহলে আমরা ইন্ডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারি কোথায় গিয়ে করব।”
বিচার বিভাগের জন্য যে কোনো কিছু করতে শুরুতে আইনজীবীদের সহায়তা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জায়গার অভাবে সাড়ে ৩০০ বিচারক আদালতে বসতে পারছেন না জানিয়ে এসকে সিনহা বলেন, “আমি যদি পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা না পাই, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাই তাহলে বিচারকদের কীভাবে বসাব? তাদের দিয়ে মামলাগুলো কীভাবে নিষ্পত্তি করাব?”
“আইনজীবীরা অন্তর্বর্তী জামিন নিয়ে কথা না বলে এসব নিয়ে কথা বললে গলা মিলিয়ে কথা বলতাম,” বলেন তিনি।
জেলা পর্যায়ে ‘ঠুনকো’ অজুহাতে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের বিষয় তুলে ধরে এক্ষেত্রে বার কাউন্সিল ভূমিকা না রাখায় তার সমালোচনা করেন প্রধান বিচারপতি।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের একটি আদালতে পুরাতন মামলা নিষ্পত্তি করতে বলায় এবং লহ্মীপুরে কয়েকজন আইনজীবীকে আদালতের জায়গায় ভবন নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়ায় আইনজীবীদের আদালত বর্জনের কথা তুলে ধরেন তিনি।
এসকে সিনহা বলেন, “আমি সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছে জানতে চাই- বার কাউন্সিল শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের মতো ভোট চাওয়ার জন্য? আপনাদের অন্যায় আবদার যেগুলো হচ্ছে ডিস্ট্রিক্ট কোর্টগুলোতে সেগুলো চোখ বুঝে সহ্য করে যাবেন কি না।”
এসব ঠেকাতে বার কাউন্সিলের ভূমিকা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “সময় এসেছে বার কাউন্সিলের যে রুলস আছে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। কেন আপনারা এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকছেন?
“আমরা যখন বারে ছিলাম আইনজীবীরা বেশ স্ট্রং ছিলেন। বার কাউন্সিল বডিও বেশ স্ট্রং ছিল। কিন্তু আইনজীবীদের এমন অন্যায় আবদার কখনও সাপোর্ট করেনি।”
সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ড রুমসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সেখানে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দেন প্রধান বিচারপতি।
আইনজীবী সমিতির নিচতলায় বইমেলা উদ্বোধনের ওই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল খায়ের। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বক্তব্য রাখেন।
৩৫টি স্টল নিয়ে শুরু হওয়া এই বইমেলা চলবে সপ্তাহব্যাপী। প্র্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মেলা উন্মুক্ত থাকবে।