রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

কুতুবদিয়া রক্ষায় সুদৃষ্টি কামনা

প্রকাশিতঃ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ১:৩৪ পূর্বাহ্ন

:: আরিফ হায়দার কুতুবী ::

kutubdiaআমার নাম কুতুবদিয়া । সাগর বক্ষে আমার অবস্থান। পর্যটন শহর কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভূক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত। বহুল পরিচিত বঙ্গোপসাগরের উদরের পানিতে সিক্ত হওয়ায় আমি আনন্দিত। আমার পাশ দিয়েই অসংখ্য নৌকা ও ট্রলার মাছ ধরতে গভীর বঙ্গোপসাগরে যায়। আমার চ্যানেলেই অবস্থান করে অগনিত বন্দরগামী জাহাজ।আমার বক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা বাতিঘরের আলোতেই পথ দেখে জাহাজের নাবিক। আমার বুকেই শায়িত আছেন অলীকূল সম্রাট হযরত আব্দুল মালেক শাহ্ (রঃ) সহ অসংখ্য পীর আউলিয়া। আমি যদি সাগরের সাথে বিদ্রোহ করা বন্ধ করে দিই তাহলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা বাঁশখালী পটিয়া এবং আমার প্রতিবেশী পেকুয়া চকরিয়া রাক্ষুসী সাগরের গ্রাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু আমি তা করি না। আমি উদার, বড় মনের।

আমার জন্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে আমার গোড়াপত্তন বাংলা ১৩০০ সনে বলে শোনা যায়। জনশ্রুতি আছে, মধ্য প্রাচ্য থেকে আগত ছৈয়দ শাহ কুতুব উদ্দিন নামের একজন আউলিয়া এখানে প্রথম আস্তানা স্থাপন করেন।শংখ,সাংগু ও মাতামুহুরী নদীর উর্বর পলি মাটি দ্বারা আমার সৃষ্টি বলে মনে করেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা। এখানকার মানুষ শিক্ষাদীক্ষা যাতায়াতসহ বাসস্থানের সঠিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও ‘স্বশিক্ষিত মানুষ’ অত্র দ্বীপের অন্যতম ঐতিহ্য। দেশীয় চাহিদার এক তৃতীয়াংশ লবণের যোগান দিয়ে থাকি আমি। এছাড়া বাগদা চিংড়ি,পোনা এবং শুটকির একটি বিরাট অংশ যোগান দিই আমি ।শুনে অবাক হতে পারেন,বাতিঘরের এই সমুদ্র জনপদে আলো নেই।দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ পাইলট প্রকল্প এই দ্বীপে স্থাপন করলেও ব্যাপক দুর্নীতি ও অযুত অব্যবস্থাপনার কারণে তা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আমার সন্তানেরা জাতীয় গ্রিডের সাথে বিদ্যুতায়নের দাবি করে আসলেও আমার কিছু স্বার্থান্বেষী সন্তানের কারণে তা আর হয়ে উঠেনি।আমার সাধ জাগে আলোকিত হতে।

আমি ৯১ সনের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের নিরব প্রত্যক্ষদর্শী।এই ঘূর্ণিঝড় আমার ১৫ হাজার সন্তান কেড়ে নিয়েছিল,আমাকে করেছিল ক্ষতবিক্ষত।আইলা ও সিড়রের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাকে ডুবিয়ে দিতে না পারলেও গত বর্ষায় রোয়ানু আমার সব ভাসিয়ে নেয়,তবে আমার করার কিছুই ছিল না, কেননা আমি অরক্ষিত ছিলাম।প্রকৃতির খেয়ালীপনায় মুহূর্তের মধ্যেই ঝরে যায় চারটি প্রাণ,আহত হয় অন্তত অর্ধশতাধিক। ক্ষতি হয় কোটি টাকার সম্পদ। যার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখানকার মানুষ। রাক্ষুসী সাগর চারটি প্রাণ নিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকেনি,দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়,বিদ্ধস্ত হয় আমাকে আকড়ে ধরা কয়েকশ গাছপালা,সাগর বক্ষে বিলীন হয়ে যায় সমুদ্রতীরবর্তী কয়েকশ ঘরবাড়ি।সেদিন পূর্ণিমা জোয়ার থাকায় সাগরে পানির বেড়ে যায়, ফলে এই ক্ষতি।

একটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে যে,রোয়ানু পরবর্তী সময়ে আমাকে ছেড়ে অন্যত্র ঠাই নিয়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার।ভয়ঙ্কর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ কিছুটা কেটে গেলেও অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা জোয়ার আমাকে প্রতিবারি তলিয়ে দেয় । সাগর আর বেড়িবাঁধ একাকার হয়ে পড়ায় গত ঈদেই সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে প্রাণ যায় আমার আরো ৪ অবুঝ সন্তানের। যার বুক চিরে আমার জেগে উঠা,যাকে আশ্রয় করে আমার সন্তানেরা জীবিকা নির্বাহ করে সেই বঙ্গোপসাগরের উপর আমার মাঝে মাঝে রাগ হয়। কেননা সে এই জনপদকে কষ্ট দেয়।প্রতি বর্ষায় বারেবারে সে নিষ্ঠুরভাবে লোকালয়ের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়। তার ভয়াল উম্মাদ চরিত্র আমাকে এবং আমার সন্তানদের ভয়ার্ত করে তোলে। এমন কোন বছর নেই, যে বছর সে এই জনপদকে তার উত্তাল জল রাশি দিয়ে ডুবিয়ে দেয় না।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, গত ২৫ বছরে আমার উপর দিয়ে বয়ে গেছে কয়েকশত সামুদ্রিক ঝড়। আমার মনে আরো একটি দুঃখ আছে। আমার সন্তান বৈমানিক,আমার সন্তান দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষক,বিদেশের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষক,গবেষক,আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী,আমার অসংখ্য সন্তান ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার। আমার সন্তানেরা সরকারের সর্বোচ্চ দপ্তরে কর্মরত,আমার সন্তানেরা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় বিভিন্ন পদে দেশ সেবায় নিয়োজিত।আমি কোনদিন আমার প্রচার বা প্রকাশ চায়নি। আমার শত বছরের লালিত স্বপ্ন ছিল নিজের সত্ত্বা নিয়ে টিকে থাকবো।কিন্তু সে সুযোগ মনে হয় আর হবে না।

উম্মাদ বঙ্গোপসাগরের জল রাশি আমাকে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে আর আমার সন্তানেরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।তাহলে আমি কি বলবো , আমার সেই প্রিয়জনগুলিও আমাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রাখা বঙ্গোপসাগরের মত নির্দয় ও নিষ্ঠুর? আমি চাই তাদের প্রতিবাদ। আমি চাই আমার প্রিয় সন্তানগুলোর স্পর্শে বেঁচে থাকবো। মা হিসেবে হিসেবে ভেবেছিলাম,আমার সন্তানেরা সমুদ্রের মত বিশাল হবে,আমার রক্ষণাবেক্ষন করবে। আমার সন্তানেরা উল্টো আমাকে নিয়েই রাজনীতি করে। আমাকে কেন্দ্র করে টেন্ডারবাজি হয়। এসব দেখে আমার লজ্জা হয়!

আমি আর লজ্জা পেতে চাই না,আমি আমার সন্তানদের বুকে আগলে রেখে বাচতে চাই। আমি চাই দলমত নির্বিশেষ সবাই আমার রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এগিয়ে আসবে। আমি আধুনিক হতে চাই,আলোকিত হতে চাই,আলোকিত করতে চাই।আর সেজন্য চাই সরকারের পাশাপাশি দ্বীপ মায়ের সূর্য সন্তানদের সুদৃষ্টি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইআইইউসি।