কাব্য-গানে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা চিরন্তন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হাসিনা আকতার নিগার :

বাংলাদেশ রক্তে ভেজা মৌন এক অন্ধকার

বাংলাদেশ শপথ নেয় তীব্র এক স্বাধীনতার

বাংলাদেশ বিশাল এক অগ্নিবূহ্য প্রজ্বলিত

বাংলাদেশ মিছিলকাঁপা শ্লোগান গান দেওয়া আন্দোলিত

শোষকের বুলেটের আঘাতে যখন নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ কিংবা বাক বিমূঢ় হয়ে যায় কারাগারে শিকলে তখন শোষিতের মুখের প্রতিবাদের ভাষা জ্বলে উঠে কাব্য কবিতা আর গান। যে গানে থাকে জীবনকে বাচাঁনোর অনুপ্রেরণা আর মুক্তির আস্বাদনের সাহসিকতা। এমনি কাব্য কবিতা বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসের পেছনে কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে।

 

শোষকশ্রেণী যতই এদেশের কবি আর কাব্যকে বাকরূদ্ধ করতে চেয়েছে ততই এখানে জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদের ছন্দ আর সুর। যে সুর বাণী আর ছন্দতে প্রতিবাদী মানুষের ধমনীতে জেগেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল ঢেউ। কবিরা মানুষের জন্য গেয়ে উঠেন-

 

জলন্ত ঘোষণার প্রতিধ্বনি তুলে

নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক

এই বাংলায়, তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা

বাঙালি জাতির চিন্তা-চেতনার সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে মহান স্বাধীনতা, ১৯৭১ এবং জাতির জনক বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিটি বাঙালির মানসপটে সুষ্পষ্টভাবে অঙ্কিত রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্বের লড়াই ‘৭১।

বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা যখন বুঝতে পেরেছিল এ জাতিকে দমন করতে হলে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লেখনী শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, তখনই তারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিমর্মভাবে গণহত্যা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর হত্যা করেছে এদেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও লেখকদের। কিন্তু না, তারা থামাতে পারেনি প্রতিবাদী কবিতার বাণীকে কিংবা গানের সুরকে। কারণ বাংলার মাটি, বাংলার মানুষের অন্তরে রয়েছে দেশপ্রেমের সুর আর বাণী। তাইতো সংস্কৃতিপ্রেমী এবং প্রতিবাদী এই জাতির অধিকার আদায়ে আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের কণ্ঠ গর্জে উঠেছে তাদের কাব্য কবিতা আর গানের মধ্য দিয়ে।

 

তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?

তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর

৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ক্ষেত্রেই সংস্কৃতিকর্মীরা গণ-জাগরণের কাজ করে এসেছে। ৫২’র ভাষা শহীদের রক্তের প্রতিশোধে কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-

 

যে ভাষায় আমি আমার মাকে সম্বোধন করি,

সেই ভাষা ও স্বদেশের নামে

এখানে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উম্মুক্ত প্রাঙ্গণে

আমি তাদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি

ভাষা আন্দোলনের এমন সব গান ও কবিতার প্রভাবে সাহসী বাঙালি জাতি তাদের ভাষার সম্মান আদায় করে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ভাষা আন্দোলনের উপর রচিত নাটক, গান, কবিতা স্বাধিকার আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, দিয়েছে দেশ গড়ার অঙ্গীকার।

স্বাধীন এই বাংলা আমার

কোটি প্রাণ শহীদ মিনার

নেবই নেব, নেবই নেব

নেবই নেব আমার মনের মতো এই দেশ গড়ে

 

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর লেখা “কবর” নাটকটি যার মঞ্চায়ন সাংস্কৃতিককর্মী থেকে শুরু করে প্রতিটি ছাত্র, জনতাকে উজ্জ্বীবিত করেছিল পরবর্তী সংগ্রামের জন্য। আজও প্রতিটি বাঙালির কাছে “কবর” নাটকটি অনন্য জাগরণী বার্তা হয়ে আছে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রম্যকথন, আবৃত্তি, গান ছিল যুদ্ধপীড়িত কোটি জনতার কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিকামী বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সেসকল জাগরণের গান শুনে উদ্যমী হয়েছে দেশকে স্বাধীন করার তাগিদে। তবে তাদের চেতনাকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণ। এই ভাষণ তাদের প্রতি রক্ত কণিকায় ছড়িয়ে দিয়েছে সঞ্জীবনী সুধা। শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নয় তারেক মাসুদ নির্মিত “মুক্তির গান” প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই কী করে শিল্পীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন। দেশমাতৃকাকে ভালবেসে গেয়ে উঠেছেন-

 

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।

মোরা একটি হাসির জন্য যুদ্ধ করি

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ জাতির জনক বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেমের অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল দেশের জনগণের অধিকার আদায়, দেশের মাটিকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি সুনিদিষ্ট ভূ-খণ্ড হিসাবে স্থাপন করা এবং পরিশেষে সোনার বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। তাঁর সংগ্রামী জীবনে তিনি আজীবন মানুষের উদ্দেশ্যে যা বলেছেন তাতে ছিল সাহসিকতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের ঝড়। তার প্রতিবাদের ভাষা কবিতায় উঠে এসেছে নানা আঙ্গিকে-

 

‘মুক্তি চাই, স্বাধীনতা চাই’

স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে –

সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরা জাগো…

কেউ দাবাইয়া রাখতে পারবা না…

নিজ ভূখণ্ডে বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।

 

নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়-

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন…

শোনালেন তার অমোঘ কবিতা খানি

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লালসবুজের পতাকা উড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মাটি ও বাংলার মানুষ পেল মহান স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা আমাদের গর্ব আর আমাদের অহংকার মুক্তিযোদ্ধারা। তবে দেশ স্বাধীনের পর এই গর্ব আর অহংকারকে নিয়ে রচিত কাব্য ও সাহিত্যচর্চার গতি দেশের অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের অপশক্তির প্রভাবে ধীর হয়ে যায়। এই অপশক্তিগুলো চাইছিল স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে মুছে ফেলতে। তবে তারা পারেনি। কারণ কবির লেখনী শক্তি থাকে তার অন্তরের ভিতর তাই সে শক্তিকে কোনো অস্ত্রের মুখে দাবিয়ে রাখা যায় না বেশী দিন। হয়ত বা ইতিহাসে সত্য প্রকাশে সময় লাগতে পারে বেশি কিন্তু ইতিহাস তার আপনধারায় প্রকাশিত হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এই অপশক্তির প্রতিবাদেও জ্বলে উঠে কবিতার ভাষা।

একাত্তর এখনো হয়নি শেষ

এখনো ঘাতক ক্ষত বিক্ষত করে দেখ

তোমার সোনার বাংলাদেশ

তবে আশার বাণী হলো, আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যায়নি। তা আজও বিদ্যমান। হয়ত বা চলার পথ হয়ে গেছে কিছুটা বন্ধুর বা অমসৃণ। বাঙালির রক্তে যেহেতু মিশে আছে কাব্যপ্রেম আর প্রতিবাদ তাই বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ও বাঙালির গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা আবার বিকশিত হচ্ছে বর্তমান সময়ে। তবে এক্ষেত্রে আবৃত্তিশিল্প অনেকটা এগিয়ে। সারাদেশ জুড়ে প্রায় দেড়শত আবৃত্তি সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের কবিতার সংকলন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সংগঠক ও নির্দেশক ফয়জুলস্নাহ সাঈদ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আবৃত্তি। কোনো বিষয়কে শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে শ্রোতাকে তার প্রতি আকৃষ্ট ও উজ্জ্বীবিত করে তোলাই আবৃত্তি। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবিদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু সেদিন শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জ্বীবিত করেছিলেন। আবৃত্তিশিল্পীরা আজও সেই জ্বালাময়ী ভাষণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন ও অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন আগামী প্রজন্মকে। তাই তো আজও আবৃত্তিশিল্পীর কন্ঠে ধ্বনিত হয়-

 

আবার আসেনি কি মহাজাগরণ, সুমহান একাত্তরে

বেহেশত হতে নয়, মানুষের মাঝ থেকে মানবিক কন্ঠ কি গর্জে ওঠে নাই-

‘আবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’

 

মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা ও গৌরবান্বিত অধ্যায় তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আবৃত্তিশিল্পীর অবিরাম কাজ করে চলেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নৃশংসতা তুলে ধরতে ও তাদের বিচারের দাবীতে তাদের কণ্ঠ সর্বদা সোচ্চার। প্রায় প্রতিটি আবৃত্তি সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিরোধীশক্তির উপর আবৃত্তি প্রযোজনা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের আবৃত্তি প্রযোজনার মধ্যে ‘আবার আসবে দিন সূর্যিত আলোর, রাজাকারের নামচা, মা, দুঃখিনী মা, এখনো একাত্তর, প্রবর্তকের ঘুর চাকায়’ প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। এ সমস্ত আবৃত্তি প্রযোজনা যেমন প্রতিটি দর্শককে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করছে তেমনি যে সকল তরুণ-তরুণী আবৃত্তিশিল্পের সাথে জড়িত তারাও একই সাথে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।

 

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এ সম্পর্কে সকলের সম্যক ধারণা রাখা উচিত। যাতে করে সেই গৌরবময় অধ্যায় থেকে ভবিষ্য প্রজন্ম নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার অনপ্রেরণা পেতে পারে। আর এর জন্য চাই ভাষার সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে আপামর জনতার কাছে সেই ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরা।

 

‘৭১-এর স্বাধীনতা অর্জন আর বাংলার আকাশে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার মাটিতে সোনার ফসল আর সমৃদ্ধ আনতে আরেক সংগ্রামে উদ্দীপিত হয়ে নেমেছিলেন ৭২ সাল থেকে। কিন্তু এবার দেশের ভিতরে অপশক্তি তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে নিজেদের স্বার্থে।

 

এসব স্বার্থন্বেষীদের কারণে ১৯৭৫ সালে বাংলা আর বাংলার মানুষ হারিয়েছে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন নৃশংতায় শুধুই মনে হয়-

 

এ কোন মৃত্যু?

কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন?

শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু,

হিমালয় থেকে সাগর অবধি

সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রঙ।

লেখক : কলামলেখক