আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১৩ সাল থেকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণিকরণ করছে ব্যাংকগুলো। নতুন নিয়মে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে ওই সময় খেলাপি ঋণ বাড়ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছিল না। পরে নানা সমালোচনার মুখে খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি হয়ে পড়া ঋণ নিয়মিত করতে ওই সময়ে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ সুযোগ নিয়ে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে শিথিল শর্তে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন ১১টি প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার ফলে খেলাপি ঋণ স্বাভাবিকভাবে কমার কথা। তবে তা না কমে গত ৬ মাসে বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে, সামগ্রিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়লেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ১৬ কোটি টাকা কমেছে। আগের প্রান্তিকে অবশ্য এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ চার হাজার ৫৭১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এতে করে আগে যেখানে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ খেলাপি ছিল, এখন কমে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশে নেমেছে। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের এক হাজার ৮২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।
গত ২১ জুলাই জাতীয় সংসদের একাদশ (বাজেট) অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল আবুল মহিত জানিয়েছেন, সরকারি ৮ ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমান ২৮ হাজার ৫৪০ কোটি ৬৭ লাখ। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ স্থিতিভিত্তিক শ্রেণিকৃত ঋণ বিবরণী অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে মোট ঋণের পরিমান ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৩৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। এ মধ্যে খেলাপীর ঋণের পরিমাণ ২৮ হাজার ৫৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ ঋণই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সঠিক উদ্যোক্তাকে না দিয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
রাজনৈতিক সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন ও বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃ তফসিলের পরও খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতি মাসেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকাররা দুর্নীতির মাধ্যমে মাঝারি ও বড় ঋণ বিতরণ করেছেন। আবার কিছু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকল্প প্রস্তাব নিয়মমাফিক পরীক্ষা করা হয়নি। অদক্ষতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেওয়া এসব ঋণই এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে।
ব্যাংকগুলো পুনঃ তফসিল করে ঋণ নিয়মিত রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। বলা যায়, দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থা খুব খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে।