মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

পুলিশের একজন বিজয় বসাক

প্রকাশিতঃ ১৩ নভেম্বর ২০১৮ | ১২:২৫ পূর্বাহ্ন


শরীফুল রুকন : ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ইউনিফর্মে চাকরি করবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কঠোর পরিশ্রম করে পুলিশের চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলেছি। বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার পেয়েছি প্রথমবারেই। জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেয়ে পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসাই বেড়েছে। পুলিশের একজন গর্বিত অংশীদার হয়ে আজীবন মানুষের সেবা করে যেতে চাই।’- নিজের কার্যালয়ে বসে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক।

পুলিশ কর্মকর্তা বিজয় বসাকের জন্ম ও বেড়ে উঠা দুটোই দিনাজপুর শহরে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। ১৯৯২ সালে দিনাজপুরের এম.জি.এন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন বিজয় বসাক। প্রথম বিভাগে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন নটরডেম কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৯৯৭ সালে। একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে ১৯৯৮ সালে স্নাতকোত্তর করেন।

২১তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে বিজয় বসাক বেছে নেন পুলিশ ক্যাডার। ২০০৩ সালে চাকরিজীবনের শুরুতে সুনামগঞ্জে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নরসিংদী ও ফরিদপুর জেলায় কর্মরত ছিলেন। ২০০৯-১০ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দারফুরে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার পদে যোগ দেন। চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর সিএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) পদে যোগ দিয়েছেন বিজয় বসাক। তিনি বলেন, ‘আমার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার মায়ের ভূমিকাই বেশী। বড় ভাই ও বোনের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তারাই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।’

কর্তব্যনিষ্ঠা ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ২০১৭ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) পেয়েছেন দিনাজপুরের ছোটগুড়গোলা গ্রামের সন্তান বিজয় বসাক। এর আগে পেশাগত দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পান। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ ও ২০১৭ সালের পুলিশ সপ্তাহে তিনি ‘আইজিপি গুড সার্ভিসেস ব্যাজ’ পেয়েছেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচবার বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার নির্বাচিত হন বিজয় বসাক।

তিনি পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করেন এভাবেই, ‘পুরস্কার পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমি কাজ করিনা। মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়ার আশায় কাজ করি। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পাওয়া সম্মানই মানুষকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখে, অনুপ্রাণিত করে ও দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার শক্তি জোগায়।’

বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দির পাশাপাশি আরবি ভাষায়ও সমান পারদর্শী বিজয় বসাক। তিনি ২০১১ সালে ইটালিতে ‘পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও নাগরিকদের সম্পর্ক’ বিষয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সবমিলিয়ে দেশে-বিদেশে অন্তত ১১টি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিভিন্ন বিষয়ে। দায়িত্ব পালনের ফাঁকে নানা বিষয়ে লেখালেখি করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর দুটি গবেষণাধর্মী লেখা ও চারটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির একটি জার্নালে ‘নারী পুলিশের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি লেখা লিখেছেন বিজয় বসাক।

গাছ লাগানো ও ফুলের বাগান-দুটোই দারুণ পছন্দ বিজয় বসাকের। সর্বশেষ বরগুনায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের সময় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেন ৩৫ হাজারের বেশী ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা। উক্ত জেলার চৌকিদার ও দফাদারদের মাঝেও বিতরণ করেন গাছের চারা। বরগুনার হলতা ডৌয়াতলা ওয়াজেদ আলী খান ডিগ্রি কলেজে ‘পুষ্প পল্লব’ নামে একটি ফুলের বাগানও করে দেন বিজয় বসাক। তিনি বলেন, বরগুনা ছেড়ে আসার আগে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। দেখি তাদের প্রত্যেকের হাতে পেয়ারাসহ নানা ফল। জানতে চাইলে বলে, আমার দেয়া গাছেই নাকি ফলগুলো ধরেছে! তাদের এই ভালোবাসাটাই আমার সেরা প্রাপ্তি।’

প্রকৃতিপ্রেমী বিজয় বসাক হাতছাড়া করেন না বিশ্বভ্রমণের সুযোগ; ইতিমধ্যে তিনি ইটালি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কেনিয়া, উগান্ডা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। পারিবারিক জীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলের বাবা তিনি। বরগুনায় পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকাকালীন মানবিক কর্মকা- ও নানা ইতিবাচক কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন বিজয় বসাক।

যদিও মানুষকে সহযোগিতা করার এই মানসিকতা বিজয় বসাকের গড়ে ওঠে স্কুল জীবনে, ‘স্কুলে পড়ার সময় আমরা অনেক বন্ধু একসঙ্গে থাকতাম, বই পড়তাম। বিভিন্ন ধরনের বইয়ের মধ্যে দেখতাম, মানুষকে সহায়তা করলে সেটা কোন না কোনভাবে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। এজন্য কিছু ছোট ছোট উদ্যোগ নিতাম আমরা। কেউ কোন বিপদে পড়লে অথবা পড়াশোনার জন্য কারো সহযোগিতা লাগলে করতাম। টাকা লাগলে টিফিনের টাকা থেকে বাঁচাতাম, অথবা বাবা-বড় ভাইদের কাছে চাইতাম যে আমার ভাই-বন্ধুর এই সমস্যা হচ্ছে- সহযোগিতা করুন।’

পুলিশের মত এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা কেন বেছে নিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর যেন বিজয় বসাকের তৈরিই ছিল, ‘আমার বাবা ব্যাংকার ছিলেন। বাবার কাছ থেকে একটা শিক্ষা পেয়েছি। যেটা হচ্ছে- মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়া। তিনি একটি উক্তি সবসময় বলতেন, পৃথিবীতে এসেছিস যখন দেয়ালে আঁচড় কেটে যা। কথাটি আমার সবসময় মনে থাকত। মারা গেলে কতজন আমাকে মনে রাখবে- সেই চিন্তা আসে মনের মধ্যে। মানুষের সেবা করতে না পারলে, ভালোবাসা না পেলে কোন কিছু অর্জনের মূল্য নেই। এই বোধ থেকেই আমি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছি।’

বিজয় বসাক বলেন, ‘অন্যায়-অবিচারে পুলিশই সবচেয়ে ভালো কাজ করতে পারে। তবে পুলিশের পাশে যে বেড়াজাল বা দেয়াল থাকে এটি মানুষ ভেদ করে আসতে চায় না। আমি সেই দেয়ালগুলো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

ছবি- আকমাল হোসেন।