ইফতেখার সৈকত, চবি : গৌরবের ২৫ বছর পাড়ি দিয়ে সমৃদ্ধির পথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) আইন অনুষদ। ১৯৯২ সালে ৪৩টি আসন নিয়ে এই অনুষদের যাত্র শুরু হয়। শুরুর দিকে ছিল না পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ কোনো অর্জন।
তবে গৌরবময় ২৫ বছর পাড়ি দিয়ে এই অনুষদ আজকে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই ২৫ বছরে এই অনুষদ থেকে পাস করে বেরিয়েছে ২০টি ব্যাচ। বর্তমানে অনুষদের আসনসংখ্যা ১১৫।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের যাত্রা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে হলেও বর্তমানে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এগিয়ে এখানকার আইন অনুষদ। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া মহাদেশেও এই অনুষদ তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিচ্ছে।
এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিচার বিভাগের মুখ্য মহানগর হাকিম, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করছেন। জুডিসিয়ালিতে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবেও কাজ করছেন কেউ কেউ। তাছাড়া এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীতে জজ, অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে কর্মরত আছেন।
বিভাগীয় মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন আদালত পর্যন্ত বিভিন্ন বিচার বিভাগের বিচারক ও আইনজীবীদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদের। তাদের মধ্যে জজ হিসেবে আছেন প্রায় ৬ শতাধিক।
তাছাড়া এ অনুষদ থেকে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে কর্মরত। এই অনুষদের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন চবি’র আইন অনুষদের কৃতী শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর রোখছানা আক্তার এ অনুষদেরই শিক্ষার্থী।
তাছাড়া এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন। এদের মধ্যে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার এডিথকোয়াম ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক ড. মোস্তফা মাহমুদ নাছের, সুইডেনের ওপসালা ইউনিভার্সিটির ড. মুনিরুল আজম, ইউনিভার্সিটি অব হার্ডপোর্ডসায়ার ড. নওরিন শিকদার, অস্ট্রেলিয়ায় প্রফেসর সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের শিক্ষার্থী।
শিক্ষকতা ছাড়াও এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে কাজ করছেন। কর্পোরেট কোম্পানিতে হেড অব দ্যা লিগেল, হেড অপ কমপ্লাইন, কমিউনিকেটর, ব্যাংকিং সেক্টর, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, ম্যানেজার লিগেল, ম্যানেজার লিগেল অ্যান্ড কমপ্লাইনসহ নানা পদে কর্মরত আছেন।
ইউএসিআর, আইসিআরসি, ইউএনডিপি’র মতো দেশি-বিদেশি এনজিও সংস্থাগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে রয়েছেন এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা।
এই অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের রয়েছে কিছু গৌরবময় অর্জন। প্রায় প্রত্যেক বছর এই অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গবেষণা, প্রতিযোগিতা ও বিতর্কে অংশ নিয়ে অর্জন করছেন নানা সম্মাননা ও পুরস্কার। শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক অর্জনের মধ্যে রয়েছে, অ্যানভাইরনমেন্টাল মুটিং কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন, ২০১৬ সালে প্রফেসর হাসান মুহাম্মদ রোমানের নেতৃত্বে ভারতে জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন প্রতিযোগিতায় ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই অনুষদের শিক্ষার্থীরা অষ্টম স্থান অর্জন করেন।
এ অনুষদের প্রফেসর জাকির হোসেন হিউম্যান ট্রাফিকিং নিয়ে ভেনিস ও নেপালের সাথে সংযুক্ত গবেষণা, প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুখ দুদুবার ইউজিসি স্বর্ণপদক ও ২০১২ সালে প্রফেসর হাসান মুহাম্মদ রোমান প্রধানমন্ত্রীর গোল্ড মেডেল লাভ করেন।
এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে অর্জন করেছেন শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী। এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, অস্ট্রেলিয়ান এইড স্কলারশিপ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ, অস্ট্রেলিয়ান স্কলারশিপ ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপসহ বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে অর্জন করেছেন শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী।
নেতৃত্বের বিচারেও এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। বর্তমানে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা বার অ্যসোসিয়েশন ও সুপ্রিমকোর্ট বারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ও সভাপতি প্রফেসর ড. আবু নোমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, এই অনুষদে বর্তমানে কোনো সেশনজট নেই। শিক্ষকরা খুবই দক্ষ এবং আন্তরিক। আর দেশের গবেষণায় প্রতি বছর এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা অসামান্য অবদান রাখছেন। এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর গবেষণা সংক্রান্ত ‘ল অব ভিশান’ প্রকাশ করে থাকেন। যেখানে থাকে শিক্ষার্থীদের গবেষণাধর্মী লেখা ও প্রবন্ধ।
এ বিভাগের সাফল্য, দেশে-বিদেশে এ অনুষদের শিক্ষার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ এশিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। প্রত্যেক বছর এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পেয়েছেন পুরস্কার ও সন্মাননা। সাম্প্রতিক সময়ে এ অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বমুটিং কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে এ অনুষদের অবকাঠামো যথেষ্ট উন্নত। সম্পূর্ণ আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন চবির আইন অনুষদে রয়েছে সুসজ্জিত লাইব্রেরি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাঠদানকক্ষ। যদি দেশের বাইরে এক্সচেইঞ্জ প্রোগ্রাম বাড়ানো যায় তাহলে এই অনুষদের শিক্ষার্থীরা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে। সাধারণত শিক্ষার্থীরা নিজেদের খরচে এক্সচেইঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল কারণে শিক্ষার্থীরা এটেন্ড করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে তবে এ অনুষদের মান আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। বলেন প্রফেসর ড. আবু নোমান।
এদিকে অনুষদের ১৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে অনুষদের সহকারী প্রফেসর হোসেন মোহাম্মদ রোমান জানান, এই অনুষদের শিক্ষার্থীদের আরও দক্ষ করতে হলে অনলাইনে তাদের কার্যক্রম বাড়াতে হবে এবং আরও বেশি এক্সচেইঞ্জ প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে হবে।
চবির আইন অনুষদের সাফল্য নিয়ে কথা হয় অনুষদের সাবেক তিনবারের ডিন প্রফেসর ড. জাকির হোসেন এবং অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসিনের সঙ্গে।
প্রফেসর ড. জাকির হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের উন্নতির পেছনে যে জিনিসটা কাজ করেছে সেটা হচ্ছে শিক্ষকদের কমিটমেন্ট এবং সিলেবাসের ভিন্নতা। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ নয়, দেশের সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থার মান বিপর্যয়ের মুখে। বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা পাস করছে ১০ থেকে ১১ জন। গত বছরের আগের বছর চবির আইন অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছিলো শতকরা ২ ভাগেরও কম শিক্ষার্থী। এর কারণ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্হা এবং শিক্ষকদের কমিটমেন্টের অভাব। শিক্ষদের কমিটমেন্ট কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের সঠিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। একজন শিক্ষকের চেয়ে কম মানের ব্যক্তি পাচ্ছে বেশি মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা। যার জন্য শিক্ষকদের ছুটতে হয় প্রাইভেট, কোচিং-এর মতো জায়গায়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন বিপর্যয়ের কারণ গবেষণায় অপ্রতুল বাজেট। যেখানে বিদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বাজেট ঘোষণা করা হয় সেখানে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ওই পরিমাণ বাজেট ঘোষণা করা হয় না।
অ্যাডভোকেট ইয়াছিন জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের উন্নতির কারণ এখানকার সঠিক ভর্তিপ্রক্রিয়া। যাচাই-বাচাই করে যোগ্য শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং শিক্ষার ভিন্নতার কারণে এ অনুষদের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বেশি সময় দিচ্ছে এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রায় শিক্ষকদের দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত টাইম দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের ক্ষতি হয়।
একুশে/এটি/আইএস