এম এইচ চৌধুরী : বৈধ কোনো ব্যবসা নেই। তবুও তাদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর কারণ হচ্ছে, তারা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারে যুক্ত রয়েছে। এতে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হলেও কিছু লোক অল্পদিনেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেও যার লাখ টাকা ছিল না, তিনি এখন কোটিপতি। আর এটা সম্ভব হয়েছে হুন্ডির পরশে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, হুন্ডি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের পাশাপাশি দুদকও কাজ করছে। হুন্ডিব্যবসা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। দুদকে এই ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্যসম্বলিত অভিযোগ আসে। এসব অভিযোগের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে অনুসন্ধান শুরু করার জন্য প্রধান কার্যালয়ে অনুমতির জন্য পাঠানো হয়। অনুমতি পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক তদন্ত করে মানি লন্ডারিং আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চারিয়া এলাকার মনির আহাম্মদের ছেলে মুহাম্মদ আবু হুরায়রার (৪৫) বৈধ কোনো পেশা নেই। তিনি হুন্ডি কারবারে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় ‘আবু হুরায়রা কর্পোরেশন’ নামে কমপক্ষে তিনটি ব্যাংক হিসাব খুলেছেন তিনি। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় ‘আবু হুরায়রা এগ্রো প্রোডাক্ট নাম দিয়েও আরও একটি ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন তিনি। এসব ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হলেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক দূরের কথা আবু হুরায়রার কোনো বৈধ ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততা নেই। এসব অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় মেসার্স আবু হুরায়রা কর্পোরেশন নাম ব্যবহার করে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট একটি নিয়মিত হিসাব খোলেন আবু হুরায়রা। এই হিসাবে ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা হয় ৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ২২১ টাকা। একই সময়ের মধ্যে হিসাব থেকে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬২ টাকা তোলা হয়। ওই হিসাব থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নবাবপুর, মাদারীপুর, রাঙ্গামাটি, শরীয়তপুর, লক্ষীপুর, খাগড়াছড়ি, সিরাজগঞ্জ, যশোর, বেনাপোল, ফেনী ও ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জেলায় লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন হওয়া এসব টাকা মূলত হুন্ডির টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে ব্র্যাক ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় মেসার্স আবু হুরায়রা কর্পোরেশন নাম ব্যবহার করে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আরও একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। ওই ব্যাংক হিসাবে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৮ লাখ ৬ হাজার ৩২৪ টাকা জমা হয়। একই সময়ে তোলা হয়েছে ২৮ লাখ ৭৪২ টাকা। এই হিসাবে শুধুই নগদ টাকা জমা হয়েছে, অন্য কোনো হিসাব থেকে উক্ত হিসাবে টাকা জমা হয়নি। আর টাকাগুলোর বেশিরভাগই অন্য ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের দুই হিসাব বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেদিন টাকা জমা হয় সেদিনই বা কয়েকদিনের ব্যবধানে টাকাগুলো তুলে ফেলা হয়েছে। হুন্ডির এসব লেনদেনের জন্য মোবাইলে নয়, বরং হোয়াটসআপ, ইমু, ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করে প্রেরক ও প্রাপকের সাথে কথা বলেন আবু হুরায়রা। হুন্ডি লেনদেন প্রসঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো আবু হুরায়রার বেশ কয়েকটি ভয়েস রেকর্ডিং এ প্রতিবেদকের সংগ্রহে আছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ বটতলী কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা হাজী আবদুস সবুরের ছেলে ইসমাইল হাবিবের বিরুদ্ধেরও রয়েছে হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ। আরাফাত এন্টারপ্রাইজ ও আনোয়ারা এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ‘অস্তিত্ববিহীন’ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ও নিজের নামে ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, পুবালী ব্যাংকে বেশ কয়েকটি হিসাব খুলে হুন্ডির কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ আছে ইসমাইল হাবিবের বিরুদ্ধে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই ব্যবসায়ী ইসমাইল হাবিবের হুন্ডির টাকা পরিবহনের সময় তার এক কর্মচারীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। কিন্তু তিনি তা গোপন করে ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে আদালতে একই বছরের ২০ জুলাই একটি মামলা করেন। অন্যদিকে একই তারিখ ও সময়ে ঘটনার কথা উল্লেখ করে ওই কর্মচারীকে অপহরণের অভিযোগ এনে ইসমাইল হাবিবের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই আদালতে পাল্টা মামলা করেছিলেন ওই কর্মচারীর স্ত্রী। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চেক প্রতারণার একটি মামলায় দুই বছর ও ২৪ এপ্রিল একই অভিযোগের আরেকটি মামলায় আট মাস সাজাপ্রাপ্ত ইসমাইল হাবিব এখন পলাতক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুন্ডি ব্যবসায় জড়িয়ে অনেকেই হঠাৎ করে লাখপতি, কোটিপতিতে পরিণত হচ্ছেন। হুন্ডি ক্রমেই ব্যাপক হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিনামূল্যে টাকা পাঠানো যায়। অর্থাৎ যারা অর্থ পাঠায় তাদের কাছ থেকে কোনো চার্জ নেওয়া হয় না। কেন? কারণ এই অর্থ পরে সোনাসহ বিভিন্ন চোরাচালানে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থপাচার করছে। শুধু বিদেশে অর্থপাচার করাই নয়, হুন্ডির মাধ্যমে দেশেও আসছে পাচার করা অর্থ। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আসার পরিমাণ কমে গেছে।
দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই অর্থের পরিমাণ বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবাকেও কাজে লাগাচ্ছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। যার কারণে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।
একুশে/এটি/এমএইচসি