কাঁদলেন, কাঁদালেন নুজহাত (ভিডিও)!

চট্টগ্রাম : বঙ্গবন্ধু মেধাবৃত্তি পরীক্ষায় কৃতী শিক্ষার্থীরা বাবার হাত ধরে এসেছিলেন পুরস্কার নিতে। এই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেললেন নুজহাত। ডা. নুজহাত শম্পা চৌধুরী; মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর আত্মজা।

গেল শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) নগরের পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ’র বলরুমে ৫৭৪ কৃতী শিক্ষার্থীকে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ফাউন্ডেশন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে বাবার শূন্যতা হাতড়ে, বাংলাদেশ নির্মাণের গল্প বলতে গিয়ে বার বার কেঁদে ফেলেন নুজহাত। তাঁর ৮ মিনিটের পুরো বক্তৃতায় ছিল বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশমাতৃকার কথা; আর থেমে থেমে কান্না। এসময় অন্যরকম এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় পুরো বলরুমে।

ডা. নুজহাত শম্পা চৌধুরী বলেন, তোমরা আজকে বাবাকে নিয়ে এসেছ না, বাবার হাত ধরে পরীক্ষা দিয়েছ না। তোমরা বাবার মুখের দিকে একটু তাকাও। আমি কিন্তু আমার বাবাকে পাই নাই। আমার কিন্তু সেই সুযোগ হয় নাই বাবার হাত ধরে এরকম একটি বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার।

আমার বয়স যখন দুই; তখন পাকিস্তানি আর্মিদের পোষ্য দোসররা, আজকের জামায়াত-শিবিরের পূর্বসুরী, আলবদর-আলশামস-এর ছেলেরা এসে আমার বাবা এবং আমার বাবার মতো অনেক ব্রিলিয়ান্ট ডাক্তার, সাংবাদিক, শিক্ষক- তাদেরকে টেনে-হিচড়ে রায়ের বাজার আর মিরপুরে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছিল, আমার বয়স তখন দুই।

কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন ঢুকরে কাঁদছিলেন নুজহাত, হাজার হাজার মানুষের সামনে গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর অশ্রুধারা, যে অশ্রু মিলে গিয়েছিল মঞ্চে-অডিয়েন্সে বসা অসংখ্য মানুষের অশ্রুর মোহনায়।

ডা. নুজহাত বলেন, আমার বাবা ছিলেন তখন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ চক্ষু চিকৎসক। আমি তাকে পাই নাই। আমাকে চক্ষু চিকিৎসক হওয়ার জন্যে আমার মাকে বিএনপি-জামায়াতের বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার সেই ‘৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক কষ্ট করে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে, যেন আজকে তোমাদের সামনে এসে কথা বলতে পারি।

নুজহাত বলেন, আমার বাবার রক্তে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই আজকে দাবি নিয়ে তোমাদেরকে একটা কথা বলতে চাই। শুধু ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমলা হবে, বড় আমলা- সেটাই কি জীবনের সর্বস্ব। অনেক টাকা হবে, বিশাল একটি পাজেরো গাড়ি থাকবে সেটাই কি জীবনের সফলতা!

এই প্রশ্ন রেখে কৃতী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ডা. নুজহাত শম্পা চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু কি আমাদের সেই শিক্ষা দিয়েছেন। আমি সেই আশায় তোমাদের কাছে আসি নাই। তোমরা বৃত্তি পেয়েছো, তোমরা মেধাবি। আমার ধারণা একদিন কথা বলতে বলতে তোমাদের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো কেউ বেরোবে। যিনি ছোট থাকতে নিজের হাতের ছাতাটা দিয়ে দিয়েছিলেন আরেকজনকে। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীত্বের লোভ ত্যাগ করেছিলেন। তোমরা হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো। তাঁরা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বিচলতি হন নাই। হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের দালালি করেন নাই। তোমরা শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদের মত হবে। শহীদ নজরুল ইসলামের মত হবে। তারা বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধুর সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বেঈমানি করেন নাই। আমি সেরকম মেধাবী চাই।

একটি চাকরির জন্য নিজেকে ‘আমি রাজাকারের বাচ্চা’ বলবে সেরকম মেধাবী চাই না। আমি চাই তুমি বঙ্গবন্ধুর মতো হবে। তুমি একদিন এবারের সংগ্রাম বলে ডাক দিবে। আমরা আবার যুদ্ধে যাবো, আমরা জামায়াত-শিবির নিশ্চিহ্ন করবো। আমি সেই আশায় তোমাদের কাছে এসেছি। তোমরা ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী’ পড়বে, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়বে। তোমরা প্রতিটি লাইন পড়বে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা আছে, বীর শ্রেষ্ঠদের কথা আছে। যোগ করেন নুজহাত।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন আট বছরের একটি ছোট্ট শিশুর গল্প শোনান নুজহাত; বলেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে সে চা আনার ফুটফরমায়েশ খাটে। আর রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর কাছে গিয়ে সমস্ত ইনফরমেশন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি ক্যাম্পের। একদিন ধরা পড়ে গেলো। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। ছেলেটি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। সে বুঝতে পারছে না তাকে মেরে ফেলবে। যে মেজরের কাছে কাজ করত সেই মেজর জিজ্ঞেস করছে- এই তুই কি বুঝতে পারছিস তোকে মেরে ফেলবে। সে নিচু হয়ে বাংলাদেশের মাটি নিল, কপালে লাগাল- বলল জয় বাংলা।’ গল্পটি বলেই অঝোরে কেঁদে দেন নুজহাত।

শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা বলেন, ‘আমি চাই তোমরা সেই মুক্তিযোদ্ধার মত হবে। দেশের জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবে। সেই সাহস তোমাদের থাকবে। কখনো তোমরা জামায়াত-শিবির, বিএনপির সাথে কম্প্রোমাইজ করবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের খুনীদের সাথে হাত মেলাবে না। দেশকে ভালোবাসবে, দুর্নীতি করবে না। মন্ত্রী-এমপি হওয়া লাগবে না। আমলা হওয়া লাগবে না। তোমরা বঙ্গবন্ধুর মত নেতা হও, তোমার পেছনে সারাদেশ থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মুহাম্মদ সাজ্জাত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, সিডিএ’র চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রাক্তন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমান্ত তালুকদার, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইমরান, ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

একুশে/এটি