চট্টগ্রাম : পঁচাত্তরের রক্তাক্ত আগস্ট পার হয়েছে কেবল। চারদিকে এক ভীতিকর, ভুতুড়ে পরিবেশ। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই যেন মহাপাপ, মহাঅপরাধ! কিছুদিন আগেও ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে যারা ফেনা তুলেছিলেন সেই আওয়ামী লীগ নেতারাও আন্ডারগ্রাউন্ডে। তখন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া মরিয়মনগর, চৌমুহনী এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসী। নাম আক্কেল আলী। সেই আক্কেল আলী প্রকাশ্যে মরিয়নমগর চৌমুহনী বাজারে বঙ্গবন্ধুর মা-মাসি ধরে গালাগাল করছে।
শুরুটা ছিল এরকম- সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মাসখানেক পর দৈনিক ইত্তেফাকে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে একটা আর্টিকেল ছাপা হয়। পাড়ার এক স্বল্পশিক্ষিত চাচা পত্রিকা পড়তেন। ইত্তেফাকের সেই আর্টিকেলটার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললেন, তোমরা তো আওয়ামী লীগ করো বাবা, দেখো তো এই জিনিসটা কী।
বললাম, ‘ইত্তেফাক সম্পাদক ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর সময় এমপি ছিলেন। এই মুদ্রাস্ফীতির জন্য তিনি কি সংসদে একবারও কথা বলেছেন। মৃত্যুর পরে কেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা ইচ্ছা তা লিখছেন, উসকানি দিচ্ছেন। লেখাটার প্রতিবাদ করার কেউ তো এখন নেই। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কি কেউ এখন কথা বলছে! এসব বলার জন্য অর্থনীতিবিদ লাগবে।’
এই কথোপকথনের একপর্যায়ে সন্ত্রাসী আক্কেল আলী (১৯৭৯ সালে গণপিটুনিতে নিহত) বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া শুরু করে। প্রকাশ করার মতো নয় এমনসব গালি মারাত্মক এক ঝাঁকুনিতে জাগিয়ে তুলে আমার শরীর-মন। ভেতরটা তোলপাড় করছে। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, তীব্র স্বরে বলে উঠলাম- গালি দিলি কেন? তোকে কখন গালি দিলাম- বলে সে। বললাম- আমাকে নয়, বঙ্গবন্ধুকে কেন গালি দিলি? বলেই বাজারভর্তি লোকের সামনে আক্কেল আলীকে জুতাপেটা করে বাজারছাড়া করি। মুহূর্তের মধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
এলাকার ময়মুরুব্বীরা বললেন, খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায়। ভয়ে-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সবাই। তোমার কেমন সাহস, শেখ মুজিবের জন্য একজন সন্ত্রাসীকে পেটাচ্ছ। এখনো সময় আছে, আক্কেল আলীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। নয়তো তোমার অস্তিত্ব থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে তোমার পুরো পরিবার। জবাব দিলাম, বঙ্গবন্ধুকে যে গালি দিয়েছে, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বাঁচার চাইতে তাকে পিটিয়ে মরে যাওয়া অনেক শ্রেয়। বললাম, প্রয়োজনে এলাকা ছেড়ে চলে যাবো, তবুও আক্কেল আলীর কাছে আত্মসমর্পণ করবো না। আমি তখন রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষার্থী। প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষাটা আর দেওয়া হলো না। বাড়ি ছেড়ে চলে আসি শহরে।
গল্পটা একসময়ের তুখোর ছাত্রনেতা আলী আকবর চৌধুরীর। আড়ালে চলে যাওয়া নির্মোহ, নির্লোভ এই মানুষটির মুখোমুখি হয়েছিল একুশে পত্রিকা। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় সেই আক্কেল আলী থেকে আজকের প্রেক্ষাপট। স্মৃতির ঝাঁপি খোলে দিলেন তিনি, একে একে বলা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু নিয়ে গালমন্দের প্রতিবাদ ও পরবর্তীতে ছাত্র রাজনীতির জন্য জীবনের যতসব ট্র্যাজিক গল্প।
আলী আকবর চৌধুরী বলেন, আক্কেল আলীকে পিটিয়ে শহরে আসার কিছুদিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হই। ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষা আর পরিশুদ্ধ রাজনীতি-দুইয়ের সমন্বয়ে দেশের জন্য কাজ করবো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের, স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়বো।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও আমি জেলার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। একটা সময়ে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই (১৯৮০-৮১)। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও খ ম জাহাঙ্গীর কমিটিতে সদস্য নির্বাচিত হই। রাজনীতিতে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। ভোগের রাজনীতি কী সেটা আমরা জানতাম না। ত্যাগে সুখ অনুভব করতাম, আনন্দ পেতাম। দেওয়াল লিখন, সাময়িকী প্রকাশ, সুখে-দুঃখে কর্মীদের আগলে রাখা, নিঃস্বার্থভাবে সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়া এসবই ছিল আমাদের রাজনীতি। আমার এসবের সাক্ষী মহিউদ্দিন ভাই (বর্তমান নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি)। তাঁর সাথে অনেক জায়গায় পার্টি চালানোর জন্য চাঁদা তুলেছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে আসছেন, ১৭ মে ১৯৮১। মহিউদ্দিন ভাইকে নিয়ে আমার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত সবার থেকে চাঁদা উঠিয়ে আটটা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় নেত্রীর সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছিলাম। তখন মহিউদ্দিন ভাইকে বলেছি, গাড়িতে আমার ছাত্রলীগের দুটি ব্যানার থাকবে। বললেন, ইয়েস। তুমি তো গাড়ির ব্যবস্থা করেছ। মহিউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই গাড়িবহরে ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে আমি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গিয়েছিলাম। অপূর্ব ট্রেডার্স ও চৌধুরী ট্রেডার্স নামের দুটা কোকোনাট অয়েলের ইমপোর্ট লাইসেন্স ছিল আমার। লাইসেন্সগুলো বিক্রি করে যা টাকা পেয়েছি, তা দলের জন্য খরচ করেছি। মহিউদ্দিন ভাই বলতেন, এই আলী আকবর পকেটে টাকা কত আছে বের করো, সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইকে বের করে দিতাম।
মহিউদ্দিন ভাই এখনো বলে বেড়ান সেইসব কথা। কিছুদিন আগে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। ঘরভর্তি নেতাকর্মীর সামনে আমাকে ইঙ্গিত করে মহিউদ্দিন ভাই বলেন, এই যে আলী আকবর চৌধুরী। আজকের ছেলেরা তাকে চিনে না, জানে না। আমি কাছ থেকে দেখেছি দলের জন্য তার ত্যাগ, শ্রম, আন্তরিকতা। পার্টি চালাতে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করেছে সে। সে টাকায় মিটিং করেছে, কর্মীদেরও ভাত খাইয়েছে। শত না পাওয়ার মাঝেও মহিউদ্দিন ভাইদের মুখে যখন এগুলো শুনি মনটা ভালো হয়ে যায়। যেমন ধরুন- হাছান (ড. হাছান মাহমুদ)। দেখলেই শ্রদ্ধায় নত হয়, বলে- আকবর ভাই আমার নেতা। হাছানের অবস্থান এখন অনেক উপরে। এভাবে অ্যাড্রেস না করলে তার কী আসে-যায়! তবু হাছানরা অকপটে যখন এগুলো বলে, গর্বে বুক ভরে যায়, অপ্রাপ্তি-হতাশার মাঝেও এক পশলা ভালোলাগা বয়ে যায় নিজের ভেতর।
বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের যেসব ছাত্রনেতা চট্টগ্রামে ছিল, তাদের মধ্যে আমি কাদের ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কাদের ভাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এলে আমাকে প্রশ্ন করতেন- আকবর, তুমি এই বইটা কিনেছো? শরৎচন্দ্রের এই বইটা পড়ছো? তখন রাজনীতি করলে পড়তে হতো, জানতে হতো। মোটকথা- একঝাঁক মেধাবী, পড়ুয়াদের ঠিকানা ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।- বলেন আলী আকবর।
তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার প্রফেসর হেলাল উদ্দিন নিজামীর মতো মেধাবী ছাত্রনেতাদের আমি রিক্রুট করেছিলাম ছাত্রলীগে। ২০০৪ সালের দিকে একদিন মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় হেলাল বললেন, আপনি আকবর ভাই না! আমি হেলাল। আপনি ভুলে গেছেন- আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। ট্রেনে সিট না পেয়ে আপনার হাঁটুর উপর বসেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বলেই জড়িয়ে ধরেন আমাকে। এধরনের অনেক ছাত্রনেতাকে আমি তুলেছি, যারা আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
ছাত্র রাজনীতিতে আলী আকবর চৌধুরীর যখন তুঙ্গস্পর্শী সময় তখনই সামনে হাজির হয় বিশাল এক ট্র্যাজেডি। মিথ্যা অপবাদে তিন বছরের বহিষ্কারাদেশ আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে ছাত্রত্ব শুধু নয়, স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয় আলী আকবর চৌধুরীকে।
সেই প্রেক্ষাপট বর্ণনায় আকবর বলেন, বখতেয়ার উদ্দিন খান তৎকালীন চাকসুর নির্বাচিত জিএস জমিরের উপর আক্রমণ করে রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। আমি ওইদিন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। মামার ভেরিয়ামিল এক্সরে করার জন্য সিএমএইচের ডা. লে. কর্নেল মহসীনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎ শেষে পায়ে হেঁটে যখন বালুচরার রাস্তায় উঠছি, তখন বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শামসুজ্জামানের সাথে দেখা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে ফিরছেন। বললেন, বখতেয়ার উদ্দিন খান তো ছাত্রসংগঠন শেষ করে দিয়েছে। ওইদিন নবীনবরণ হওয়ার কথা। তার কাছেই শুনলাম বখতেয়ার উদ্দিন খান ছেলেপুলে নিয়ে জমির চৌধুরীকে মারতে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার জন্য বখতেয়ার উদ্দিন খান, সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ও জয়নালের সাথে আমাকেও তিনবছরের জন্য বহিষ্কার করা হলো। আমার সাথে রাজনীতিতে, সাংগঠনিকভাবে পেরে না উঠায় আমার প্রতিপক্ষরা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। রাউজান কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। আমি একটা প্যানেল দিয়েছি, ওরাও একটা দিয়েছে। ওরা সেকান্দর, আমি দিয়েছি বাবর-আনোয়ার। আমার প্যানেল জয়লাভ করেছে। নিজামপুর কলেজে ওরা দিয়েছিল আতা-রহিম। আমি দিয়েছিলাম আতা-মশলু। আর একটা প্যানেল দেয়া হয়েছিল। ওখানেও আমরা পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করেছিলাম। এই কারণে গ্রুপিং রাজনীতি অতঃপর জমির হত্যা চেষ্টা মামলায় আমার নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল রাজনীতিতে থেকে আমাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য।
অথচ আক্রমণের শিকার জমির চৌধুরী নিজেই বলেছেন, ভিসি স্যারকে গিয়ে আমি বলবো তুমি ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলে না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভিসি স্যারের কাছে। কিন্তু ভিসি স্যার একসাথে দুইজনকে ডাকেননি। ওনাকে একা ডেকেছিলেন। ভিসি স্যারের অফিস থেকে বের হয়ে জমির আমাকে বললেন, আমি বলে দিয়েছি। এরপরও আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলো না।
শাহ আজিজ তখন প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। মামলা প্রত্যাহারের জন্য উত্তর জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা, তিনিও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন, শাহ আজিজের সাথে যোগাযোগ করে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আমাকে বলেন। বললেন, চলুন ঢাকায় যাই। তিনি তখন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ঢাকায় যাওয়ার পর বলেন, আমরা কালকে শাহ আজিজের কাছে যাব। ওনার হাতে যোগদানপত্র দিয়ে ছাত্রদলে যোগদান করবো। মামলা, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেবো। আমি বললাম, প্রশ্নই উঠে না। আমার মামলাও থাক, বহিস্কারাদেশও থাক। শেষ পর্যন্ত আমরা চলে আসলাম।
বহিষ্কারাদেশ আর হুলিয়া নিয়ে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়তে হলো আমাকে। আমাকে পুলিশ খুঁজছে। এখানে-ওখানে পালিয়ে কাটছে আমার দিন। গ্রেফতার এড়াতে শেষপর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হই। আমার ঠিকানা হলো সৌদি আরবে। পরিশ্রমের কাজ করতে পারি না। সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস স্কুলের কিছু ছাত্র পড়িয়ে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করি। সেখানে কোনো রাজনীতি করিনি। সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতাম। সৌদি আরবের প্রথম ১৫ আগস্ট আমি বঙ্গবন্ধুর জন্য ওমরা করি। আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি। যত বছর সৌদিতে ছিলাম প্রতি ১৫ আগস্ট আসলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য নীরবে ওমরা করতাম, কাউকে বুঝতে দিতাম না। ১৯৯২ পর্যন্ত নিয়মিত করে গেছি কাজটি। প্রিয় বঙ্গবন্ধুর জন্য আর কী বা করার আছে আমার মতো অতি ক্ষুদ্র মানুষের!- বলেন আলী আকবর।
তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে সৌদিআরব থেকে দেশে ফিরি। পাসপোর্টে আমার রি-এন্ট্রি ভিসা ছিল। নাছির ভাই (আ জ ম নাছির, বর্তমান সিটি মেয়র), সফর আলী ভাই (বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা) তৎকালীন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশাররফ ভাইয়ের বাসায় নিয়ে যান আমাকে। মোশাররফ ভাই ও সালাম ভাইয়ের কমিটির মেম্বার করার কথা ছিল আমাকে। সফর আলী ভাই তখন বলেছেন, আলী আকবর চৌধুরী আর বিদেশ যাবে না। তাকে কমিটিতে রাখতে হবে। তাকে দরকার আছে। কিন্তু পরে কেন জানি সেটা আর হলো না। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী সালাম ভাই (চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের (চেয়ারম্যান) এখনো বলেন, আপনি একটু অ্যাকটিভ হোন। আপনাকে এটা করবো, সেটা করবো। ইউনুছ গণি চৌধুরী কতবার বলেছে- আপনি একটু চলুন না মোশাররফ ভাইয়ের বাসায়। বাসায় গিয়ে নেতৃত্ব খুঁজে নেব, সেটা হয়তো আমি পারবো না। আজকে উত্তর জেলার সংগঠনগুলো আমার হাতে গড়া। তখন যারা ছাত্রলীগ করতো, তারা এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। বিভিন্ন থানায় থানায় তারা দায়িত্ব পেয়েছে। বর্তমানে এমন অনেক নেতা আছে, আমি সংগঠন গোছানোর জন্য থানায় গেলে তারা আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতো।
এই প্রসঙ্গে একটু পেছনে ফিরেন আলী আকবর চৌধুরী। বলেন, ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে ছাত্রলীগ করেছি। ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে ছাত্রলীগ করেছি। ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাশ করে রাঙ্গুনিয়া কলেজে ভর্তি হই। এসময় কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে পেরে উঠছিল না ছাত্রলীগ। ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাব ছিল রাঙ্গুনিয়া কলেজে। তখন আমি রাঙ্গুনিয়া কলেজে ছাত্রলীগের অবস্থান সুসংহত করতে ভূমিকা রাখি। আমি কলেজ-ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই আকবর আসছে, আকবর আসছে বলে হইচই পড়ে যেতো। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আমরা রাঙ্গুনিয়া কলেজের ছাত্ররা মিছিল করে রাঙ্গুনিয়া থেকে চন্দ্রঘোনা গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম।
নান্দনিক ছাত্ররাজনীতির ফেরিওয়ালা আলী আকবর চৌধুরীর দল টানা রাষ্ট্রক্ষমতায়। কিন্তু কোথাও, কিছুতে নেই তিনি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঠিকাদারি করার চেষ্টা করেন। মিথ্যার আশ্রয় নেন না, কাজে নিম্নমানের জিনিস দিতে পারেন না বলে সেখানেও লোকসান গোনেন। তখন তার পাশে অভয় আর সহযোগিতার ছাতা নিয়ে হাজির হন জীবনসঙ্গীনি নূরজাহান আক্তার দীপ্তি। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করে তিনিই হাল ধরেন, পাশে থাকেন নির্মোহ স্বামী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই সন্তানের।
আলী আকবর চৌধুরীর কোনো আক্ষেপ নেই। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব ছাপিয়ে এখনো তিনিই বলতে পারেন, এখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্নের সোনার বাংলা হচ্ছে, তারই সুযোগ্য কন্যা সাফল্যের সাথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এর বেশি কী চাই!