‘দেহজীবীর যৌবন চলে গেলে হয় না, সংবাদপত্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে চলে না’

চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এক চরম বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এসিসটেন্ট এডিটর অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘দুই বাংলার সাংবাদিকতা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে কথা বলেন ভারতীয় এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। চট্টগ্রাম রিপোটার্স ফোরাম (সিআরএফ) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

চট্টগ্রামে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্প গ্রুপ খবরের কাগজ চালায়। কেউ কেউ খবরের কাগজটাকে ব্যবসার সুবিধার জন্য ব্যবহারও করছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধাও তেমন আছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হয়, সেটা হচ্ছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।

‘অমুক গ্রুপের কাগজ এটা, ও তো ওই জায়গায় এটা করেছে। ওরা আর কী লিখবে? পাঠকের মধ্যে এই ধারণাটা তৈরী হয়ে যায়। এটা একটা সমস্যা। এই সমস্যাগুলো বাংলাদেশের কাগজ ফেইস করে। বিশেষ করে যখনই জমানা পাল্টায়, তখন প্রতিশোধ নেয়ার একটা ব্যাপার চলে আসে।’

আওয়ামী লীগ সমর্থিত পত্রিকা বিএনপি এলে বন্ধ করে দেয় জানিয়ে অনমিত্র বলেন, একই অবস্থা জনকন্ঠেরও। এখন মিটমিট করে জ্বলছে। সেজন্য আমার যেটা মনে হয়, মিডিয়া যদি নিজের জায়গায় ঠিক থাকে, অর্থ্যাৎ সমালোচনার কোন কাজ করলে সমালোচনা হবে, সেটা কে আমার দেখার দরকার নেই।

‘এটা একেবারে থিউরিটিক্যাল কথা আমি জানি। এটার প্র্যাকটিক্যাল অনেক সমস্যা আছে। বেশী সমালোচনা করতে গিয়ে মাঠে মারা পড়ে যায়। এসব প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা। এর মধ্যেও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কলকাতার মিডিয়া, চট্টগ্রামের মিডিয়া এগিয়ে চলেছে।’

তিনি বলেন, আজ ৯০ বছর হয়ে গেল, আনন্দবাজার পত্রিকার মালিক পক্ষের এক এবং একমাত্র ব্যবসা হচ্ছে মিডিয়া ব্যবসা। সঙ্গে দ্বিতীয় কোন ব্যবসা নেই। আমি খবরের কাগজে যদি সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখি, তাহলে আমার যে বহুতল আবাসন নির্মাণের প্রতিষ্ঠান আছে… সেখানের কাজটা আটকে যাবে। এই শঙ্কা তাদের নেই। বরং আমি যদি খবরের কাগজে সরকারকে তেল মেরে লিখতে শুরু করি, আমার পাঠক কমে যাবে। তখন আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে।

‘সুতরাং এই জায়গা থেকে ১০০ শতাংশ মিডিয়ার ব্যবসা আনন্দবাজারের আছে। তারা মিডিয়া বাড়িয়েছে। আমাদের দুটো বাংলা দৈনিক, একটি ইংরেজি দৈনিক, তার সাথে চারটি টিভি চ্যানেল.. যা চারটি ভাষায় চলে, এর বাইরে অনলাইনে অডিও-ভিজ্যুয়াল তো আছেই।’

বর্তমানে অনলাইন পোর্টালের প্রসারে প্রিন্ট মিডিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন অনমিত্র।

তবে এ সংকট ভারতীয় মিডিয়া কিভাবে কাটিয়ে উঠছে সে কথাও জানিয়েছেন তিনি।

‘একটি পণ্যের, র‌্যাংগস টেলিভিশনের সব বিজ্ঞাপন আগে প্রিন্ট মিডিয়ায় যেত। এখন তার সিংহভাগ চলে গেছে টেলিভিশন-অনলাইনে। এ সব সমস্যা মোকাবেলা করেই মিডিয়া এগিয়ে চলেছে। এটা হচ্ছে মিডিয়ার ভেতরের সমস্যা। এর বাইরের সীমাবদ্ধতা ভারত-বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশে এক।’

অনমিত্র বলেন, ‘একদিকে চ্যালেঞ্জে পড়ছে, অন্যদিকে সেটা আবার কাটিয়ে উঠছে। বিজ্ঞাপনের যে বরাদ্দ সেটা প্রিন্ট পত্রিকাকে না দিলে টিভিকে তো দেবে। ঠিক করলাম, আমি আমার র‌্যাংগস টেলিভিশনের ১০ কোটি টাকা বিজ্ঞাপন দেবো। আগে ১০ কোটি টাকাই প্রিন্ট মিডিয়াকে দিতাম। এখন আমি ৬ কোটি টাকা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার জন্য রাখছি। চার কোটি টাকা প্রিন্ট মিডিয়াকে দিচ্ছি। প্রিন্ট মিডিয়া ৬ কোটি টাকা লস করলো। কিন্তু মালিক লস করলো না। কারণ সেই ৬ কোটি টাকা মালিকের অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়া পেয়েছে। এটা একটা সুবিধা। ওখানে আনন্দবাজারের মতো সবচেয়ে বড় অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়া হচ্ছে এপিবি আনন্দ। হয় আনন্দবাজারকে দিতে হবে, নয়তো এপিবিকে দিতে হবে। এই হল ব্যাপার।’

পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে পছন্দ করার যুক্তি তুলে ধরেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

তিনি বলেন, সাংবাদকিতায় যতটা না আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, তার চেয়ে বেশী এতে সম্মান আছে। এবং সাংবাদিকতার মাধ্যমে সামাজিক কিছু কাজকর্ম করা যায়। এই ভালোবাসা থেকে, নেশা থেকে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি।


নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনমিত্র বলেন, কোনো সরকারই চায় না সরকারবিরোধী কোন লেখা, মিডিয়া লিখুক। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা সব জায়গায়ই তৎপর। এই তৎপরতা চালাতে তাদের অনেকটা সুবিধা আমরাই করে দিয়েছি। সেটা দুটো কারণে। এক নম্বর হচ্ছে- ব্রেকিং নিউজ, দুই নম্বর হচ্ছে ফেইক নিউজ।

অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দায়-দায়িত্ব জ্ঞানহীন খবর ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তার মতে, প্রিন্ট পত্রিকায় কিছু কিছু ভুল থাকলেও একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যা খবর বেরিয়েছে- এমন উদাহরণ একেবারেই কম। কিন্তু অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় ফেইক নিউজ অহরহ হচ্ছে।

‘ঢাকায় একজন অভিনেত্রী ফেইসবুক লাইভে এসে বললো তিনজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, যে যেভাবে পারো তাদের হেল্প করো, বলে দিলেন। এবং একটি নামি টিভি চ্যানেল তা ব্রেকিং নিউজ দিয়েছিল। পরে কী কাণ্ডই না হলো। এই দায়-দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য শাসকশ্রেণী অস্ত্র পেয়ে যায়। মিডিয়াকে আটকাতে… তারা একটা ভালো সুযোগ পেয়ে গেল। এই সমস্যাটা সমস্ত জায়গাতেই হচ্ছে।’

এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সংবামাধ্যমকে প্রভাবিত করছে জানিয়ে অনমিত্র বলেন, আমি খবর একটা দিলাম না। কিন্তু ফেইসবুক, টুইটারে সেটা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং খবর না ছেপে পার পাওয়ার উপায় নেই এখন। খবর আমাকে দিতেই হবে। নয়তো পাঠক, আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কী কেন দিলে না? আমি তো পয়সা দিয়েই খবরের কাগজ কিনলাম। তাহলে এটা নেই কেন?

সংবাদমাধ্যম হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার প্রতি জোর দিয়েছেন অনমিত্র; তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক পেশায় একটা দায়বদ্ধতার ব্যাপার আছে। যেমন যে দেহজীবী তার যদি যৌবন চলে যায়, তাহলে তার আর কী-ই বা থাকলো। একইভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা যদি সংবাদমাধ্যমের চলে যায়, তাহলে তার আর কিছুই থাকে না।’

‘আমরা যেটা করি, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে… পুলিশ প্রধান থেকে শুরু করে যেই করুক, যার বিরুদ্ধেই হোক, পাড়ার মুদি দোকানদার থেকে শুরু করে শিল্পপতি পর্যন্ত। বলে দিল যে, তার বিরুদ্ধে এই এই অভিযোগ, আটারো কোটি টাকা অমুক নিয়েছে, তমুক দিয়েছে.. সেই অভিযুক্ত ভদ্রলোকের সাথে কথা না বলে, প্রতিক্রিয়া না নিয়ে আমরা সেটা ছাপি না। কারণ চোরেরও আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে, একটা খুনিরও আছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় হয়, তার সাথে যোগাযোগের পরও সে এড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে এসএমএস করলাম যে, দাদা আপনার বিরুদ্ধে এই এই অভিযোগ, আপনি কিছু বলবেন? তারপরও উত্তর এল না। তখন আমরা লিখে দিই যে, তাকে ফোন করা হয়েছে, এসএমএস করা হয়েছে, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অন্তত এইটুকু লিখে আমাদের পক্ষ থেকে যে চেষ্টা করা হয়েছিল, ব্যাপারটা ওখানে থাকে।’

চট্টগ্রাম রিপোটার্স ফোরাম (সিআরএফ) এর সভাপতি কাজী আবুল মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গণমাধ্যমের অর্ধশতাধিক সাংবাদিক অংশ নেন।

একুশে/এসআর/এটি