স্টাফ রিপোর্টার :
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং জঙ্গিতৎপরতা রোধ করতে ফেইসবুকসহ ৯টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে চিঠি দেয়ায় গত বুধবার দুপুর ১২টার কিছু সময় পর টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশনা দেয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হলেও এসব অ্যাপস পুরোপুরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি সরকার। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এসব অ্যাপস ব্যবহার করতে না পারলেও তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষরা প্রক্সি সার্ভার দিয়ে অনায়াসেই ব্যবহার করছেন অনেকেই।
প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ মোকাবেলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে, অ্যাপস বন্ধ করে এর সমাধান সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।সরকার ফেইসবুক বন্ধ করে দেয়ার পরও গত বুধবার থেকেই অনেকেই ফেইসবুক ব্যবহার করছেন। রাজধানীসহ সারাদেশ থেকেই ফেইসবুক, ভাইবারসহ বন্ধ করে দেয়া সবকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস ব্যবহার করার খবর পাওয়া গেছে। যারা ব্যবহার করছেন তারা সকলেই ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বন্ধ হওয়ার পরও ব্যবহারের বিষয়ে লিখেছেন। অনেকেই আবার বন্ধ করার পরও ব্যবহার করতে পারা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষরা ফেইসবুক ব্যবহার করতে পারলেও যাদের দক্ষতা কিছুটা কম তারা পড়েছেন বিপাকে। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর অনেকেই ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষরা ফেইসবুক ব্যবহার করতে না পারায় সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
হারুনুর রশিদ নামের একজন সক্রিয় ফেইসবুক ব্যবহারকারী বলেন, প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ফেইসবুকে যেতে পারছি না। মনে হয় নিজে পিছিয়ে পড়ছি। কারণ ফেইসবুক থেকে অনেক আপডেট তথ্য পান এই চাকরিজীবী। আরেক ফেইসবুক ব্যবহারকারী মাহবুবুর আলম বলছেন, কি যেন হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। যারা ফেইসবুক ব্যবহার করছেন তাদের প্রায় সকলেই বন্ধ করার বিষয়ে একটি-দুটি করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই ব্যঙ্গ করে লিখেছেন ফেইসবুক বন্ধ তারপরও স্ট্যাটাস দিলাম। ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ মানে কি? লগ ইন করলাম, পাইলাম! বাংলালায়ন মডেম দিয়ে। প্রতিবেশিকে বলতেই তিনি গ্রামীণ মডেম দিয়েও দেখি স্ট্যাটাস দিলেন… যদিও ভিপিএন হয়ে। তবে চলছে তো’।
আসিফ নামে একজন কক্সবাজার থেকে লেখেছেন ফেইসবুক নাকি বন্ধ কিন্তু এক ছোটভাই আমাকে ফেইসবুক অ্যাক্টিভ করে দিলো। ছেলেপেলে যে কি এক্সপার্ট হইছে? এই দেশে ফেইসবুক বন্ধ করতে পারবে না। এছাড়া মোবাইল ফোন থেকেও বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রক্সি সাইট ব্যবহার করে ফেইসবুক ব্রাউজিং করছেন অনেকে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির এই সময়ে এসে লোকজনকে এতটা বোকা ভাবার কোন কারণ নেই। তথ্য-প্রযুক্তি এখন কোন জায়গায় চলে গেছে সে সম্পর্কে সরকারের লোকজনের বোধহয় কোনও ধারণাই নেই। কারণ সরকার একদিকে এসব মাধ্যম বন্ধ রাখার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্যে এগুলোর ব্যবহার যথারীতি চলছেই”।
তিনি জানান, এখন এমন সব সফটওয়্যার আছে যা যে কেউ চাইলেই ইন্টারনেটে ডাউনলোড করে তার সাহায্যে ফেইসবুক ব্যবহার করতে পারে। আর সেটাই করা হচ্ছে এখন। এর ফলে একজন ফেইসবুকে ঢুকলেও বাংলাদেশের আইপি অ্যাড্রেস সেখানে দেখাবে না। দেখাবে অন্য কোনও দেশের অ্যাড্রেস। এধরনের প্রযুক্তিকে বলে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন সফটওয়্যার। বিটিআরসি পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ সক্রিয় ফেইসবুক ব্যবহারকারীকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। তবে ১০ শতাংশ কারিগরিভাবে বেশি দক্ষ হওয়ায় প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করতে পারছেন।
বিটিআরসি’র হিসাব বলছে, দেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে শুধু ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। যাদের বড় একটি অংশ মোবাইল ফোনে ফেইসবুক ব্যবহারকারী। বাংলাদেশে ফেইসবুকে ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সীদের হার ৪২ শতাংশ। অ্যাপস বন্ধ সমাধান নয় : প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ মোকাবিলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। অ্যাপস বন্ধ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। নিরাপত্তার কথা বলে ফেইসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপস বন্ধ করার বিষয়ে এমনটাই বলেছেন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, বিনা মূল্যে মুঠোফোনে কথোপকথন, বার্তা ও ছবি-ভিডিও বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী এমন শত শত অ্যাপস ব্যবহার হচ্ছে। কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করে কোনো কিছুর সত্যিকার সমাধান হবে না। কোনো অ্যাপস বন্ধ করলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়।
এ প্রসঙ্গে তাঁরা কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেইসবুক বন্ধ করার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, সে সময় প্রক্সি সার্ভার দিয়ে তরুণেরা নানাভাবে ফেইসবুক ব্যবহার করেছেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কোনো অ্যাপস বন্ধ করা নয়; বরং সক্ষমতা বৃদ্ধিই সমাধান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রকে দুর্বল দেখতে পাই।’ মোস্তাফা জব্বার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম জনবল তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, ‘এখন যে অবস্থা হয়েছে সেটা সরকারের অবহেলার জন্য হয়েছে। সরকারের মধ্যে প্রযুক্তিগত অপরাধ মোকাবিলার মতো পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও জনবল নেই। এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আমরা সামাল দিতে পারব না।’ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরোধে গত বুধবার ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, লাইন, ট্যাংগো, হ্যাংআউট, ইউস্টার্ন ডট টিভি, কমিউ’র মতো ৯টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।