ওমর ফারুক হিমেল, দক্ষিণ কোরিয়া : ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’- ভুপেন হাজারিকার সেই গান যেন তাঁর জীবনের গান, ধ্যানের গান, ভাবনার গান। মানুষের ঘ্রাণ পেলেই ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। ছুটে যান তাদের কাছে, তাদের পাশে। মানুষ ছাড়া যেন চলেই না। তাই অহর্নিশ মানুষ নিয়েই তার কাজ, ছুটে চলা।
কেউ অসুস্থ; রোগে-শোকে আক্রান্ত স্বশরীরে হাজির তিনি। কারো চাকরি দরকার, মানবিক সাহায্য প্রয়োজন- সেখানেও উজ্জ্বল, দেদীপ্যমান হাতছানি তার। জন্মদিন-মৃত্যুদিন, গান-আড্ডা, সামাজিক-সাংগঠনিক আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ সবকিছুতেই তার সরব উপস্থিতি। তিনি ছাড়া সবই যেন ম্রিয়মান, অপূর্ণ, অর্ধসত্য।
পুরো সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য সেই মানুষটিকে চাই-ই চাই! দক্ষিণ কোরিয়ায় সবার প্রিয়জন হয়ে উঠেছেন, সুন্দরে, সৃজনে হয়েছেন উজ্জ্বল, দেদীপ্যমান। কী বাংলাদেশি, কী কোরিয়ান- ভিনদেশিদের কাছেও সমান পরিচিত, প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠা মানুষটি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সন্তান, নাম ম্যাক্সিন চৌধুরী।
উচ্ছ্বল, উজ্জ্বল, টগবগে এই তরুণের বয়স ৫০ এর ঘর ছুঁয়েছে। এখনো যেন ২৫ বছরের তেজোদীপ্ত, টগবগে তরুণ। কোরিয়ায় তাকে বাংলাদেশিদের সাহসের বাতিঘর বলা হয়, বলা হয় অন্ধকারে উৎসারিত আলোর মশাল।
২৬ বছর ধরে আছেন কোরিয়ায়। পেয়েছেন কোরিয়ার নাগরিকত্ব। সেখানেই প্রেম, সেখানেই বিয়ে। কোরিয়ান সুদর্শনী চে উ জং-এর সঙ্গে প্রেমের বন্ধন অতপর গাঁটছড়ার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তারা আজ কোরিয়ার সুখী দম্পতি, সুখী গৃহকোণ।
তাদের ঘর আলোকিত করে আছে আরাধ্য সন্তান সিনু। সমাজে বাড়বাড়ন্ত লোকসংখ্যার ভিড়ে সন্তানকে ‘মানুষ’ গড়ার স্বপ্নে বিভোর এই দম্পতি। নৈতিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি সন্তানকে দুই দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির শিক্ষা দিচ্ছেন নিয়ত। পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন গিটার প্রতিষ্ঠানে, কোরিয়ান থেকেন্ডু ট্রেনিং সেন্টারে।
ম্যাক্সিন চৌধুরী পারিবারিকভাবেই সংস্কৃতিমনা, সুরপাগল। রাঙ্গুনিয়ার উত্তরে মেঠোপথে বাড়ি। সেখান থেকে রাঙ্গামাটি ৩০ মিনিটের দূরত্ব। সেই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ছেলেবেলায় পড়তে গেছেন রাঙ্গামাটি সরকারি হাই স্কুলে। সেখানে হেঁটেছেন সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখায়। গড়ে তোলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে। সেখানেও ধরে রাখেন সাংস্কৃতিক ধারা।
আড্ডা, আয়োজনে সুরের মাতামাতি করেন। গড়ে তুলেন সংগঠন। যুক্ত হন প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতিতে। লালসবুজ পতাকার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছাটা আরো বেশি তীব্র, তীক্ষ্ম হয় কলেজ ক্যাম্পাসে এসে। এখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে পাড়ি জমান সিঙ্গাপুর ১৯৯২ সালে। সেখান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায়।
চিনতেন না, জানতেন না কোরিয়ার কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা, পরিবেশ-প্রতিবেশ। অচেনা, অজানা পথঘাট, মানুষজন সবকিছু। প্রথম জীবনে কোরিয়ায় চাকরি করেছেন, পরবর্তীতে যুক্ত হন যৌথ ফার্নিচার ব্যবসায়। এখন কোরিয়ার একটি নামি ওষুধ কোম্পানির বড় কর্তা।
কোরিয়ার যান্ত্রিক, ব্যস্ত জীবনেও দেশকে, দেশের মানুষকে ভোলেননি ম্যাক্সিন। তাদের টানে দেশে ছুটে যান সময়ে অসময়ে। বাংলাদেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগের স্বপ্ন তাঁর। মাঝারি আকারের একটি কোম্পানি করার ইচ্ছার কথাও জানান এই স্বপ্নবাজ তরুণ।
কোরিয়ার যান্ত্রিক জীবন, কর্মব্যস্ত আখ্যান। সেই উপাখ্যানে জড়িয়েও দেশের জন্য, দেশমাতৃকার জন্য যে ভাবনা, সেই ভাবনা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি ম্যাক্সিন চৌধুরী। অসম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন প্রবাসে বসে। জাতির জনকের মতো করে বলেন, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো। ম্যাক্সিন সবসময় ন্যায্যতা ভালবাসেন, সমতা পছন্দ করেন।
কোরিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটি ও চট্টগ্রামের মানুষদের সমতার চোখে দেখেন। কোরিয়ার ২৬ বছরের প্রবাস জীবনে বিভিন্ন কোম্পানিতে অন্তত ৩শ’ বাংলাদেশিকে চাকরি পেতে সহযোগিতা করেছেন। কোরিয়ান প্রবাসী ও কোরিয়ানদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, নিজেকে তৈরি করেছেন সেবক, দয়াবান মানুষ হিসেবে। চট্টগ্রামের ১২ তরুণকে নিয়ে গড়ে তুলেন অর্থনৈতিক ফোরাম। মাসিক উপার্জনের একটি বিশাল অংক ফোরামে জমা দেন তারা। কোরিয়ান প্রবাসী ও কোরিয়ানদের ভালবেসে উজাড় করে দিয়েছেন।
বিখ্যাতজনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ টাকা জমায়, আমি জমাই মানুষ।’ ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের মতে, ‘মানুষ আপন টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর।’ সেই উক্তিগুলো ম্যাক্সিন শুনেছেন কিনা তিনিই ভালো জানেন। শুনুন বা না-ই শুনুন মহামনিষীদের বিখ্যাত এই উক্তিগুলোর মতোই ম্যাক্সিন নিজেকে মেলে ধরেছেন কোরিয়ার মাটিতে।
‘টাকা’ পর করে মানুষকে আপন করেছেন। টাকা না জমিয়ে জমিয়েছেন ‘মানুষ’। এভাবেই কোরিয়ার জামাই ম্যাক্সিন হয়ে উঠেছেন কোরিয়ার মাটিতে বাংলাদেশিদের পরোপকার ও বিনয়ের প্রতীক।
কোরিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করে আনন্দ পান, তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। এই আনন্দকে স্থায়ী রূপ দিতে, বড় পরিসরে স্বদেশিদের জন্য কাজ করতে তিনি যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে। একে একে নির্বাচিত হয়েছেন কোরিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম অ্যাসোসিয়েশান অফ সাউথ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেসিএফের সেক্রেটারি, দক্ষিণ কোরিয়াস্থ চট্রগ্রাম স্টুডেন্ট ফোরামের উপদেষ্টা।
একুশে/ওএফএইচ/এটি