‘অপারেশন জ্যাকপট’ : ইতিহাস-বিকৃতি রোধে প্রধানমন্ত্রীকে নৌকমান্ডোর চিঠি

চট্টগ্রাম : নৌ-কমান্ডো বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নদীপথ, সমুদ্রপথ ও বন্দর ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এটি গঠন করা হয়। তাদের হাত ধরে বদলে গিয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক হিসেব। নৌ-কমান্ডোরা ভেঙে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আস্থার মেরুদণ্ড। তাদের দেশপ্রেম, সাহস ও বীরত্বের মিলিত গল্প রুখে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের বিদেশি সাহায্যের পথ! নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত সবচেয়ে সফল অভিযান হিসেবে ধরা হয়- ‘অপারেশন জ্যাকপট’।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় এই কীর্তিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে একটি উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অপারেশন জ্যাকপটের লোমহর্ষক, রোমাঞ্চকর কাহিনীসহ বন্দরের মুক্তিযুদ্ধ ও সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের ঘটনাবলী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রযোজনায় নির্মিত হতে যাচ্ছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য যুদ্ধ-চলচ্চিত্র। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণা শেষ হয়েছে। ছবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের কাজও শেষ। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর মহরত। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করবেন ‘স্বপ্নজাল’ খ্যাত নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম।

তবে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রের কাহিনী অতিরঞ্জিত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিহাসেরও বিকৃতি ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন নৌ-কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির স্থায়ী বাসিন্দা আবু মুসা চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ওই আবেদনে অপারেশন জ্যাকপটসহ সকল নৌযুদ্ধের সক্রিয় যোদ্ধা আবু মুসা চৌধুরী লিখেছেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে জেনে আমি আনন্দিত। আবার বিস্মিত এবং মর্মাহতও। জানতে পেরেছি, চলচ্চিত্রের কাহিনী অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিহাসেরও বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। সে বিষয়টি আপনাকে অবগত করতে চাই। আরও জানাতে চাই, কেবল ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের কৃতিত্ব উঠে আসবে না। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক সফল অপারেশনগুলোর চিত্র তুলে আনতে হবে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উঠে আসার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মও উপকৃত হবে। নইলে এ বিষয়টি পূর্ণাঙ্গতা পাবে না।

অপারেশন জ্যাকপটের কাহিনীসূত্র কোনোভাবেই বাংলাপিডিয়া হতে পারে না উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা চৌধুরী লিখেন, বাংলাপিডিয়ার তথ্য নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ারবুক ও অপারেশনে অংশগ্রহণকারী নৌকমান্ডোদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য তথ্য হবে বলেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

একাত্তরের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো জাহাজ ধ্বংস হয়নি বলেও ওই চিঠিতে দাবি করেন নৌ-কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী। যদিও বন্দরের কর্ণফুলী নদীতে ওই অপারেশনে ৯টি জাহাজ লিমপেট মাইন দিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেয় নৌকমান্ডোরাÑ এমন তথ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকাশনা বন্দরবার্তায় একটি লেখা লিখেছেন অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্র গবেষণা দলের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন বন্দর কর্মকর্তা ও সাংবাদিক আ ক ম রইসুল হক বাহার।

আবু মুসা চৌধুরীর মতে, অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক শোডাউন হয়েছে। এতে কোনো জাহাজ ধ্বংস না হলেও আমরা পাকবাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। অপারেশন জ্যাকপটে পাকবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আবু মুসা চৌধুরী দাবি করেন, ‘অপারেশন জ্যাকপটে এমভি হরমুজ ও এমভি আব্বাস নামে দুটি জাহাজ ধ্বংস হয়- এটি অসত্য তথ্য। ওই অপারেশনে এ নামের কোনো জাহাজ ধ্বংস হয়নি। এ ধরনের কোনো তথ্য বন্দরের ইয়ারবুকেও নেই।’

তবে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২ টায় ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শুরু হয়। কমান্ডোরা জাহাজে মাইন সংযোজন করে ফেরত আসেন। কিছু মাইন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিস্ফোরিত হয়। রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর প্রকম্পিত হয়। বন্দরে ‘এমভি হরমুজ’ এবং ‘এমভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজে ৯ হাজার ৯১০ টন এবং এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল।’

অন্যদিকে উইকিপিডিয়ায় বলা হচ্ছে- সফল অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি হরমুজ ও এমভি আল-আব্বাসের পাশাপাশি ওরিয়েন্ট বার্জ নামের মোট তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজ ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ৯৯১০ টন অস্ত্রসম্ভারবাহী এই জাহাজটি ১৩ নং জেটিতে নোঙর করা ছিল। এমভি আল-আব্বাস ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ আগস্ট ১২ নং জেটিতে অবস্থান নেয় এবং ওরিয়েন্ট বার্জ ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল বলে উইকিপিডিয়ায় উল্লেখ আছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে নৌ-কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী জানান, যুদ্ধকালে নৌকমান্ডোদের তিনটি গ্রুপ ছিল। তিন গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন শাহ আলম বীরউত্তম, মাজহার উল্লাহ বীরউত্তম ও আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীরউত্তম। সাগর ও নদীতে কমান্ডো অপারেশনকালে এসব গ্রুপ-কমান্ডারের কোনো দায়িত্ব ছিল না। কমান্ডোরা নিজ নিজ দায়িত্বে অপারেশন পরিচালনা করতেন।

তিনি অভিযোগ করেন, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন কিন্তু, কখনও নদী বা সাগরে নামেননি। এভাবে প্রত্যক্ষভাবে অপারেশনে অংশ না নিয়ে মাজহার উল্লাহ পেয়েছেন বীরউত্তম ও খোরশেদ আলম নামে আরেকজন বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী যুদ্ধের সময় খোরশেদ আলমদের শহরের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন এবং সেখানে থেকে অপারেশন বিষয়ে মনগড়া রিপোর্ট করে খেতাবের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত করে দেন। তখন কোন রিপোর্টের ভিত্তিতে নৌকমান্ডোদের খেতাব দেয়া হয়েছে তা আজও অজানা রয়ে গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নির্মিত চলচ্চিত্রে নৌযুদ্ধের ইতিহাস নির্মোহভাবে তুলে ধরার অনুরোধও জানান একাত্তরের রণাঙ্গণের নৌকমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী।

‘অপারেশন জ্যাকপট’ চলচ্চিত্র গবেষণা দলের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন বন্দর কর্মকর্তা ও সাংবাদিক আ ক ম রইসুল হক বাহার চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকাশনা বন্দরবার্তায় একটি লেখা লিখেছেন, অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে; সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৯ জন নৌকমান্ডো অংশ নেন। তবে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ বিষয়ে উল্লেখ আছে, নৌ-সেক্টরের অধীনে ১৪৮ জন কমান্ডো চারটি দলে ভাগ হয়ে অপারেশন জ্যাকপটে অভিযানে অংশ নেন। চট্টগ্রাম বন্দরের অভিযানে অংশ নেন ৬০ জন, মংলা বন্দরে ৪৮, চাঁদপুর নদী বন্দরে ২০ এবং নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদী বন্দরে ২০ জন কমান্ডো।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন নৌ-কমান্ডো এ ডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলে আসছেন, ৪০ জন কমান্ডো বিস্ফোরক, স্টেনগান, গ্রেনেড ও ডেটোনেটর নিয়ে অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নেন। এ নৌ-কমান্ডোর বরাত দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরও প্রকাশ হয়েছে।

অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ও গানবোটে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সমরাস্ত্র, পণ্যবাহী জাহাজ ও গানবোট নৌ-কমান্ডোরা ধ্বংস করে বলে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে উল্লেখ করা হয়। তবে এতে ধ্বংস হওয়া জাহাজের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন নৌ-কমান্ডো এ ডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম স্মৃতিচারণমূলক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরের ১১টি জেটি ও তিনটি জাহাজে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে ডেটোনেটর ও মাইন স্থাপন করেন নৌ-কমান্ডোরা। পরে রেডিওর খবরে তিনি শুনতে পান চট্টগ্রাম বন্দরে সবগুলো জেটি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং নয়টি ছোট-বড় জাহাজ ডুবে গেছে।

অপারেশন জ্যাকপটের ইতিহাস নিয়ে তথ্যগত নানা অমিল থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নৌ-কমান্ডোদের ওই অভিযান ছিলো অপরিসীম গুরুত্ববহ। সফল অভিযানের পর বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তা গুরুত্বসহকারে প্রচার হয়। এতে পাকিস্তান সরকার বিদেশে ব্যাপক জবাবদিহিতার মুখে পড়ে। পাকবাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। বিশ্ব দরবারে আমাদের বীরত্বও ফুটে উঠে।

অপারেশন জ্যাকপট নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী অভিযান ছিল। কেননা বুকে মাইন বেঁধে দ্রুত সাঁতরে জাহাজে তা লাগিয়ে আসতে হতো- যে কোনো সময় বাজতে পারতো এলার্ম, ঘটতে পারতো বিস্ফোরণ। অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ছিলো ধরা পড়ার ঝুঁকি। এসব প্রাণঝুঁকি নিয়েই অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অসীম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন তারা। সময়ের এ সন্তানদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।

একুশে/এসআর/এটি