যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এর ফলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা’র দণ্ড কার্যকরে আর আইনি বাধা থাকল না।
নিয়ম অনুযায়ী তারা এখন কেবল নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলে সরকার দণ্ড কার্যকর করবে।
সাকা ও মুজাহিদ দুজনেই রয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি শিগগিরই ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বুধবার এক মিনিটের ব্যবধানে দুই রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণা করে। দুই ক্ষেত্রেই প্রধান বিচারপতি শুধু বলেন, “ডিসমিসড”।
বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
মুজাহিদ ও সাকা হলেন তৃতীয় ও চতুর্থ যুদ্ধাপরাধী, যাদের সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে।
গত দুই দশকে চটকদার, ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনো কখনো ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছেন সালাউদ্দিন কাদের। আর ২০০৭ সালের অক্টোবরে আইন সংস্কার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে মুজাহিদ দাবি করেছিলেন, দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নেই; যুদ্ধাপরাধীও নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিষ্ঠুরতার দায়ে সর্বোচ্চ আদালত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে তার করা রিভিউ খারিজের মধ্য দিয়ে সেই দণ্ডই বহাল থাকল।
আর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আল বদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশও বহাল রয়েছে তার করা রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে।
আপিল বিভাগের এই বেঞ্চ গত ১৬ জুন মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করে। আর সালাউদ্দিন কাদেরের আপিলের রায় আসে ২৯ জুলাই। দুই রায়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল থাকে।
তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করার জন্য নির্ধারিত ১৫ দিন সময় শেষ হওয়ার এক দিন আগে ১৪ অক্টোবর তারা রিভিউ আবেদন করেন।
মঙ্গলবার মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের ওপর প্রায় তিন ঘণ্টা শুনানি শেষে আপিল বিভাগ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় আদেশের সময় রাখে। আর বুধবার সকাল ৯টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা শুনানি শেষে আদালত একই সময়ে রায় ঘোষণা করে।
দুই শুনানিতেই আসামিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
‘ডিসমিসড’
সাবেক দুই মন্ত্রীর রিভিউ শুনানি ও আদেশের দিন থাকায় মঙ্গলবার সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের সবগুলো প্রবেশ পথে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। প্রবেশের সময় সবার পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে পুলিশ, সন্দেহ হলে করা হয় তল্লাশি।
আদেশ শুনতে আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীরা সাড়ে ১১টার আগে থেকেই আদালত কক্ষে জড়ো হতে থাকেন। ভিড়ের কারণে তাদের অনেককে নির্ধারিত আসনের দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এজলাস কক্ষে রাখা ঘড়িতে তখন বাজে ১১টা ৩৪। এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। তারা আসন নেওয়ার পর আদালত কক্ষে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।
ক্রম অনুসারে প্রথমে আসে মুজাহিদের রায়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ডিসমিসড’।
এরপর সাকার ক্ষেত্রেও আসে একই রায়- ‘ডিসমিসড’।
দুই মিনিটের ব্যবধানে দুইবার এ শব্দটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়ার।
দুই পক্ষের প্রতিক্রিয়া
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে জাতির প্রত্যাশ পূরণ হয়েছে।…দণ্ড কার্যকরে এখন আর কোনো আইনি বাধা নেই। কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্তে সাজা কার্যকর করবে। অবশ্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আলাদা বিষয়।”
দুই আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেন, “আমরা আইনজীবী, আমরা আইনের লড়াই করেছি। আমরা হেরে গেছি, ব্যাস। এইটুকুই প্রতিক্রিয়া।”
পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “এটা সম্পূর্ণ সরকারের উপর নির্ভর করে। কখন কার্যকর করবে, কী করবে, আদৌ করবে কি-না, এটা সরকারের উপর নির্ভর করে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না, তা আসামিই ঠিক করবেন।
“ক্ষমা না চাইলেও রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে দণ্ডাদেশ কমাতে পারে, মওকুফ করতে পারে। আমাদের বর্তমান আইন অনুসারে যে কারও দণ্ড কমাতে পারে।”
দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচার
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়।
চূড়ান্ত রায়ে চলতি বছরের ১৬ জুন আপিল বিভাগ মুজাহিদের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে প্রথম অভিযোগে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
তবে রিভিউ শুনানিতে মুজাহিদের আইনজীবী শুধু মৃত্যুদণ্ডের সাজাটি নিয়েই কথা বলেছেন। এটি আইনসম্মতভাবে হয়নি দাবি করে তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। সেখানে প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
এর মধ্যে চার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।
এ বছর ২৯ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে আটটিতে দণ্ডাদেশ বহাল রাখে, একটিতে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়।
৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল রাখা হয়।
২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকলেও ৭ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের সাজার ক্ষেত্রে আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ।
১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছর কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয় চূড়ান্ত রায়ে।
সাকা চৌধুরীর দাবি, একাত্তরে ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান আর ফেরেন ১৯৭৪ সালে। আইনের ভাষায় একে বলা হয় ‘প্লি অব অ্যালিবাই’। অর্থাৎ, অপরাধ সংগঠনের সময় ও স্থানে আসামির উপস্থিত না থাকা।
রিভিউ আবেদনের শুনানিতে তার আইনজীবী তেমনই দাবি করে আসছিলেন। এ জন্য পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে আনা একটি সার্টিফিকেট তারা আদালতে তুলে ধরেন। তবে অসামঞ্জস্য থাকায় আদালত তা গ্রহণ করেনি।