কাগজপত্র ছাড়া বছরের পর বছর চলে গাড়ি, অবলম্বন কেইসস্লিপ

চট্টগ্রাম : নির্দিষ্ট টাকা দিলেই ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায় আইনভঙ্গের মামলার স্লিপ। যাতে লেখা থাকে-গাড়ির কাগজপত্র পুলিশের কাছে জমা, মামলা চলছে। ফলে গাড়ির কোনোপ্রকার কাগজপত্র না থাকলেও মামলার ওই স্লিপ নিয়ে পুরো দেশ বেড়ানো সম্ভব। পুলিশ ওই গাড়ি ধরবে না।

প্রসিকিউশন স্লিপ বই বা কেইসস্লিপ বইয়ের অপব্যবহার করে ‘মান্থলি মামলা’নামের এই ধরনের মিথ্যা মামলার প্রচলন আছে চট্টগ্রামেও।

২০১৬ সালে ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সার্জেন্ট আনোয়ারুল হক (সার্জেন্ট কোড-৯০) একটি কেইসস্লিপ ইস্যু করেন। এই কেইসস্লিপে অভিযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন কামাল উদ্দিন। গাড়ির নম্বর চট্টমেট্রো ট ১১-০২৭০। নিয়ম অনুযায়ী ২১ দিনের মধ্যে কেইসস্লিপ নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু তা দেড় বছরেও নিষ্পত্তি না হওয়ার অভিযোগ আছে।

‘মান্থলি মামলা’ নামের ভুয়া মামলার কাগজ দেওয়ার ফলে স্লিপবইয়ের অফিসকপি ট্রাফিক কার্যালয়ে জমা না দিয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা গায়েব করে ফেলেন বলেও অভিযোগ।

মোটরযান আইনে এই ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠে সার্জেন্ট আনোয়ারুল হকের বিরুদ্ধে, ২০১৪ সালে। এমনকি প্রাথমিক তদন্তশেষে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও দায়ের হয়। নগর পুলিশের তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) তাহমিনা তাকিয়া উক্ত বিভাগীয় মামলা তদন্ত করেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় সার্জেন্ট আনোয়ারুল হককে ‘গুরুদণ্ড’দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন তিনি।

অভিযোগ আছে-শুধু উপরোক্ত মামলা নয়; কেইসস্লিপ কেলেঙ্কারির একাধিক তদন্তপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করেন সার্জেন্ট আনোয়ারুল হক। টিআই (প্রশাসন)-এর দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তার সহযোগিতা ও নানা চেষ্টা-তদবিরে বারবার এসব বিষয় ধামাচাপা দিতে সক্ষম হচ্ছেন তিনি।

বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর ট্রাফিক পুলিশের উত্তর জোনের সার্জেন্ট (প্রসিকিউশন) হিসেবে কর্মরত আছেন আনোয়ারুল হক। এর আগে তিনি বন্দর জোনের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান কর্মস্থলে যোগদানের পরও পুরোনো কায়দায় সার্জেন্ট আনোয়ারুল হক টো স্লিপ ও স্লিপবইয়ের অপব্যবহার শুরু করেন বলে অভিযোগ।

প্রসিকিউশনের চেয়ারে বসেই হরদম তিনি কেইসস্লিপ দিয়ে যাচ্ছেন। সার্জেন্ট প্রসিকিউশন আনোয়ারুল হকের দেয়া এধরনের বেশ কয়েকটি স্লিপ এসেছে একুশে পত্রিকার হাতে। গত ২৬ এপ্রিল ২০১৭ সুরুজ গোমেজ নামে জনৈক ব্যক্তিকে একটি কেইসস্লিপ দেন আনোয়ারুল হক। সেখানে তিনি ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন এবং ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট মেয়াদোত্তীর্ণ দেখিয়ে মামলাটি করেন। অথচ এ কাজটি করার কথা মাঠপর্যায়ে যেসব সার্জেন্ট দায়িত্ব পালন করেন তাদের।

অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট (প্রসিকিউশন) ও টিআই(প্রশাসন)-এর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই মূলত স্লিপবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। পুলিশের ভেতর ও বাইরের লোকদের নিয়ে গড়া একটি চক্রের পকেটে এ খাত থেকে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, প্রসিকিউশনে স্লিপবইয়ের ভয়াবহ অপব্যবহার চলছে। ট্রাফিক সার্জেন্ট ও টিআই’রা অবতীর্ণ হয়েছেন কেস স্লিপবাণিজ্যে। যার কারণে মোটরযান আইনে মামলা বৃদ্ধি পেলেও গড় জরিমানার হার কমেছে।

একুশে পত্রিকার অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্পটে ১৮০ জনের মতো সার্জেন্ট দায়িত্ব পালন করছেন। এরা প্রত্যেকে মাসে গড়ে একশ’ থেকে চারশ’ কেইসস্লিপ নিয়ন্ত্রণ করেন। ২৮ দিন মেয়াদের প্রতি কেইসস্লিপ থেকে গ্রহণ করছেন ১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা। প্রতি কেইসস্লিপের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব খাতে দেড়-দুইশ’ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা তারা পকেটস্থ করছেন। এক হাজার টাকা করে গড়ে ২০০ কেইসস্লিপ হিসাব করলেও ১৮০ সার্জেন্ট এ খাতে মাসে বাণিজ্য করেন অন্তত ৪ কোটি টাকা। স্লিপবাণিজ্য নির্বিঘ্ন করতে ক্ষেত্রবিশেষে ট্রাফিক বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদেরও ‘ম্যানেজ’ করতে হয় বলে জানা গেছে।

এদিকে, ২৮ দিন পরপর ১ থেকে দেড় হাজার টাকায় কেইসস্লিপ নিয়ে রাজপথ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ থাকায় অনেকেই বিআরটিএ গিয়ে সরকারের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেটসহ যানবাহনের কাগজপত্র আপডেট রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। একশ্রেণীর ট্রাফিক পুলিশের পকেটে এভাবে বছরের পর বছর কেইসস্লিপ খাতে কোটি কোটি টাকা ঢুকলেও বিআরটিএ তথা সরকার বছরে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শুক্রবার সকালে এসব বিষয়ে কথা বলতে সার্জেন্ট প্রসিকিউশন আনোয়ারুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি। রিং হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গত সপ্তাহে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান একুশে পত্রিকাকে বলেন, এধরনের কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। ডিপার্টমেন্টালি সেগুলোর তদন্ত হচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি।

সার্জেন্ট প্রসিকিউশনের চেয়ারে বসে আনোয়ারুল হকের কেইসস্লিপ লেখার বিষয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, তাই নাকি? তিনি কি সেটা করতে পারেন! বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো।

একুশে/এসআর/এটি