বিশ্ব ‘মানুষদিবস’

মো. আবদুল মান্নান : পৃথিবীতে প্রায় সমস্ত ভাল বিষয়ের জন্য একটি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে। খোঁজ নিলে বছরের একটি দিনও পাওয়া যাবে না কোনো না কোনো দিবস উদযাপন ব্যতীত। অথচ এই সকল আয়োজন এবং সকল মহৎ ভাবনার মূল কারিগর বা মুখ্য নিয়ামক (মহান সৃষ্টিকর্তার পর) মানুষ। অথচ গাছ-পালা, বৃক্ষ-লতা, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু, নদ-নদী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাবা-মা, শিশু, বৃদ্ধ, বন্ধু-বান্ধব সব কিছুরই দিবস রয়েছে এবং সবই মানুষের দ্বারা পালিত হচ্ছে। যৌক্তিক কারণেই আমাদের একটি ‘বিশ্ব মানুষ দিবস’ থাকতে পারে।

২. লক্ষ কোটি সৌর বছরের পুরোনো আমাদের এই পৃথিবী। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতিতে বা অক্ষর, ভাষা, বিদ্যা, ধর্ম-কর্মে সে বর্তমানে যে জায়গায় এসে আজ উপনীত হয়েছে তার পুরোটাই মানুষের নিরন্তর সাধনার ফল। মানুষের ত্যাগের ফল। মানুষের জীবন বিসর্জনের ফল। সৃষ্টিলগ্ন থেকে একটি মুহূর্তের জন্য মানুষ স্থির থাকে নি। এক পলকের জন্য সে কর্মবিরতি দেয় নি। এক সেকেন্ডের জন্য সে উদাসীন হয়ে পড়ে থাকে নি। মানুষের এই গতিময়তা, কর্মস্পৃহা আর নব নব উদ্ভাবনীর মহাজাগতিকতা যেন বিরামহীন।

মানুষের এমন অভাবনীয় অগ্রযাত্রা নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত রুশ লেখক ও ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি কীভাবে ভেবেছেন দেখি, “চেয়ে দেখ মানুষের দিকে, কী বিস্ময়কর আর কী সুন্দর! অন্তহীন দিগন্তের পানে এ যেন এক পদযাত্রী। সেই আদিমকাল থেকে সে যাত্রা করেছে শুরু। কত ঝড়ঝঞ্ঝা, সংস্কার, ভ্রান্তির কুয়াশা ভেদ করে এই পথিক অগ্রসর হয়ে চলেছে। গতি তার শ্লথ হতে পারে, কিন্তু ঊঁচু তার শির, দৃঢ় তার পদক্ষেপ; সম্মুখে তার জটিল জিজ্ঞাসা। তবু পথচলায় তার ক্লান্তি নেই। উর্ধ্বাকাশে সংখ্যাহীন তারকার মতই অধোলকে সে অসংখ্য। এ নিয়ে চলেছে এই মানুষ। জিজ্ঞাসায় জিজ্ঞাসায় তার গতি সম্মুখপানে আর উর্ধ্বপানে”।

৩. পৃথিবীর সকল গ্রন্থ, কী শিল্প-সাহিত্য, কী ধর্মশাস্ত্র, এমন কি কাঠে, পাথরে, শিলায় খুদিত করা যে কোনো গ্রহে যে কোনো হরফে পাওয়া দৃশ্যমাণ বাণী সবই মানুষের জয়গান, মানুষের অভিজ্ঞতা, মানুষের সুখ-দুঃখ-বেদনা, কান্নার অসাধারণ অভিব্যক্তির প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছু নয়। সমস্ত বাক্য, সমস্ত গীতসুধা সবই যেন মানুষের অবিনশ্বর সৃষ্টি। শুধু মানুষের ইতিহাসের চিরন্তন মঙ্গলবচন। দুনিয়ার সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত সকল বিজ্ঞানের আঁধার আল কোরআনেরও মূল বিষয় ‘মানুষ’। আর এর প্রথম শব্দ ‘পড়ো’।

প্রসঙ্গত বলা যায়, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব, রামায়ণ, মহাভারত সবাই অকপটে, অবলীলায় গেয়েছেন মানুষের জয়গান, মানুষের বীরত্বকাহিনী। বিশ্বরাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি বা জগতের হেন নীতিশাস্ত্র নেই যার কোনো একটি মানুষকে বাদ দিয়ে হয়েছে বা হওয়া সম্ভব হয়েছে কখনো। এ যাবৎ পৃথিবীতে লিখিত ইতিহাসের সন্ধান বা আবিষ্কার থেকে প্রাপ্ত সকল উপাত্ত্বই কেবল মানুষকেন্দ্রিক। বাইরে যা বলা হয়েছে তাও মানুষের অপরাজেয় কীর্তিতে ভরপুর এক অভুতপূর্ব দলিল বৈ কিছু নয়।

৪. মহামতি গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা এবং মানবতাবাদী। যিনি কেবল মানুষ এবং প্রকৃতির মৌলিক শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ব্যক্তি মানুষকেই সৃষ্টিকর্তা মনে করতেন। ‘জীবাত্মার উন্নতি সাধনই’ ছিল তার বিশ্বাসের মূলমন্ত্র, মূলশক্তি। চতুর্দশ শতাব্দীর গীতিকবি চন্ডীদাস মানুষের জন্য সবচেয়ে দামী কথাটি বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমস্ত সাহিত্য-শিল্পে-কাব্যে, গীতিতে মানুষের হাসি-কান্না-বেদনা, আনন্দ, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা তথা স্মৃতি-বিস্মৃতির কালজয়ী উপাখ্যান রচনা করে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের ভেতরে বাস করে শক্তিশালী মানুষ’। মহাত্মা গান্ধী বিশ্বে অহিংস মতবাদের প্রবক্তা। রাজনীতিক, মানবতাবাদী দার্শনিক। যিনি কখনও বল প্রয়োগে দাবী আদায়ের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বলতেন, ‘ঐক্যবদ্ধ নিরস্ত্র মানুষ সশস্ত্র মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং সৃষ্টিশীল’। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”।

নোবেল বিজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করার পূর্বেও একবার বলেছেন, “মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না কখনও। হেরে যাওয়ার জন্য জন্ম হয় নি মানুষের”। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি”। আমাদের প্রজম্মের এক কবি বলেছেন, “মানুষ জমায় টাকা, আমি জমাই মানুষ। মানুষ টাকার চেয়ে দামী”।

৫. মানুষের অবিনাশী গল্পের ইতিহাস যেহেতু অশেষ, সংখ্যাতীত এবং তাকে বাদ দিয়ে পৃথিবী অস্তিত্বহীন কাজেই আসুন, ভবিষ্যতে ‘বিশ্ব মানুষদিবস’ নামে আমরা একটি দিবস পালন করি। এ দিবসে কোথাও বড় কোনো আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব বা জাঁকজমক অনুষ্ঠান হবে না। এর জন্য কোনো ছোট বড় বাজেট বরাদ্দ বা আর্থিক সংশ্লেষ থাকার প্রয়োজন নেই। ঐদিন আমরা সবাই একজন আরেকজনকে শুধু দেখবো। পলকহীন দৃষ্টিতে চলমান পথচারি দেখবো। ঘরের ভেতরে শিশু ও বৃদ্ধকে দেখবো। সকল আপনজনকে দেখবো। বাইরে রাস্তা ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান কর্ম-চঞ্চল মানুষের ঢল দেখবো। ঐদিন কোনো হিংসাদ্বেষ থাকবে না। আমরা সবাই সকলের গুণকীর্তন করে করে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করবো। জয় হোক সৃষ্টির সেরা মানুষের। জয় হোক মানবতার।

একুশে/এমএএম/এটি