মাহবুবা সুলতানা শিউলি : তোমরাই রিয়াল হিরো। তোমরা দেখিয়ে দিয়েছো, রাষ্ট্রকে কীভাবে মেরামত করতে হয়। জন্মের পর থেকে যা দেখিনি তোমরা তাই করে দেখিয়েছো। স্কুল-কলেজ, পড়াশুনা, কোচিং-এর জন্য আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন থেকে তোমাদের এই সময়েও জ্যামের কারণে চট্টগ্রামের চকবাজারের রাস্তার যে বেহাল অবস্থা দেখেছি, রাস্তা যথেষ্ট পরিমাণে পরিসর করার পরও। কোনোদিনও ভাবিনি এত সুন্দর সারি সারি সাজানো লাইনে, রিক্সার একলাইন, টেক্সির একলাইন, গাড়ির একলাইন, আবার সেফটি/ইমার্জেন্সি লাইনও দেখবো, অবাক করে দেয়! স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ঢাকায় প্রথমবার ইমার্জেন্সি লেন আবার তা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সও যেতে পেরেছে। আমি নিজে দেখেছি। গাড়ি থামিয়ে গাড়ির কাগজপত্র, ড্রাইভারের লাইসেন্স চেক্ করে ‘ওকে’ বলে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আমার গাড়ির ড্রাইভারটাকে সিট বেল্ট বাঁধতে বললে, সমস্যা নেই এইসেই বলে বাঁধতো না। ছোট ছোট ছেলেগুলোর ভয়ে সে সিট বেল্ট বাঁধতে বাধ্য হয়েছে। সিট বেল্টের নট না বাঁধতে বাঁধতে টাইট হয়ে গেছে। বেচারাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে একবার বাঁধা, একবার খোলা, এসব করতে করতে। আমরা যা শিখাতে চেয়েও পারিনি আমাদের নতুন প্রজন্মের ভয়ে তা করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ কখনও এ চিত্র দেখেনি যা আমাদের নতুন প্রজন্ম করে দেখিয়েছে।
ইশ্ এ সুন্দর চিত্র ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে যদি সারাজীবনের জন্য দেখতে পেতাম! রোড এক্সিডেন্ট বলে কোনো ওয়ার্ড আছে, তা বাংলাদেশের মানুষ চিরতরে ভুলে যেত। এ মুহূর্তে রাস্তার এই চিত্র আমাদের দেশের, বিদেশের নয়! আহ্ ভাবতে কী যে ভালো লাগছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর লোকজন যা করে দেখাতে পারেনি আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের শিক্ষার্থীরা তা করে দেখিয়েছে! আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই দেশের উন্নয়ন ও শৃংখলা শেখার প্রয়োজন। সদিচ্ছা ও সততা থাকলে যে সবকিছুই করা সম্ভব, এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদের এ সোনার টুকরা ছেলেগুলো। যে ট্রাফিক পুলিশ অন্য গাড়ির লাইসেন্স ও কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা দেখার কথা অথচ তাদের ব্যবহৃত বাইকের লাইসেন্স ও কাগজপত্রের ঠিক নেই! এসবের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে আমাদের প্রতিবাদী আন্দোলনরত ছাত্রদের দ্বারা। আন্দোলনরত ছাত্ররা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স ও কাগজপত্র চেক করেছে। অথচ র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও ট্রাফিকদের গাড়ি অতীতে কেউ থামাতে পারেনি! ছোট-বড় সব গাড়ি থামিয়েছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। এমনকি মন্ত্রী, এমপি’র গাড়িও ছাড় পায়নি। বাকিটা সবাই পত্রিকায় পড়েছেন আশাকরি।
অ্যাম্বুলেন্স বা যে কোনো ইমার্জেন্সির জন্য একটি লেইন, রিকশার জন্য একটি লেইন এবং অন্যান্য বাসগুলোর জন্য একটি লেইনের ব্যবস্থা করতে পারলে সড়কে আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়! ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো চিরতরে বাতিল করে অপরিপক্ক চালকরা যাতে হ্যান্ডেল ধরতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতে হবে। ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করতে হবে যাতে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা না হয়! নেতাদের ফুটপাত ব্যবসা চিরদিনের জন্য বন্ধ করানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। ছাত্ররা পারলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পারবেন না কেন? কেবল দরকার সদিচ্ছা ও সততা। তাই সকল হীনন্মন্যতা ত্যাগ করে আসুন না ছোটদের কাছ থেকে আমরা কিছু শিখি।
প্রতিবছর বার বার ফিরে আসে সেই বেদনার দিন ১১ জুলাই’ ১২। আজ থেকে ছয় বছর আগে মিরসরাইয়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণ কেড়ে নেয় এক অভিভাবকসহ ৪৫ শিক্ষার্থীর। ঠিক তখনই যদি এ আন্দোলন হতো তবে আমরা মো. সাইদুর রহমান পায়েল, দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম রাজীবকেসহ অসংখ্য নিরপরাধকে হারাতাম না!
এবার ফিরে যাও তোমরা। এগুলো তোমাদের কাজ নয়। যাদের কাজ তারাই করুক সদিচ্ছা ও সততার সাথে। ছোট হয়েও তোমরাই তো শিখিয়ে দিয়ে গেলে। যারা নিজেদের মানুষ ভাবেন, ন্যূনতম বিবেকবোধ যাদের থাকবে, লজ্জিত হয়ে আশাকরি যার যার দায়িত্ব, সে সে পালন করবেন।
তোমাদের ৯ দফা দাবীসহ সবই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। এ যৌক্তিক আন্দোলনে তিনিও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তোমাদের পাশে আছেন। এবার ওনার কাজ ওনাকে করতে দাও।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এ স্লোগান এখন সময়ের দাবি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে জনগণ ও সরকার সহমত পোষণ করেছে। কারণ, ছাত্ররা আমাদের শিখিয়েছে জনগণের দাবি আদায় করতে হলে ভাংচুর করতে হয় না, আগুন লাগাতে হয় না, এসিড নিক্ষেপ করতে হয় না। তারা সুশৃংখলভাবে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করেছে, তারা দেখিয়ে দিয়েছে কী পরিমাণ লোকদের লাইসেন্স নেই। এ অনিয়ম থেকে মন্ত্রী-আমলারাও বাদ পড়েননি। দায়িত্বশীল লোকদের এমন অদায়িত্বশীল আচরণ আমাদের বিব্রত করেছে। সরকারও বুঝেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশ কিছু জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। ৬৯ থেকে এ যাবৎ ছাত্রদের কোনো দাবিই ব্যর্থ হয়নি। ছাত্ররা চায়, সুশৃংখল গণপরিবহণ ব্যবস্থা। আমরা সবাইও তা চাই। এ দাবি কোনো রাজনৈতিক দলের দাবি নয়, এদেশের সকল মানুষের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে জনগণকেও সরকারের পাশে থাকতে হবে।
সুতরাং বিশ্বাস রাখো,
“আমরা নই একা, আমরা নই একা, আমরা নই একা আজকে, অাহা বুকের গভীরে আমরা জেনেছি যে, আমরা নই একা আজকে।
একদিন স্বপ্নের ভোর আসবেই, এই মনে আছে বিশ্বাস, আমরা করি বিশ্বাস, একদিন স্বপ্নের ভোর আসবেই।”
যৌক্তিক আন্দোলন কলংকিত হবার আগেই ঘরে ফিরো তোমরা। পুনরায় পড়াশুনায় মন দাও। কারণ দুর্বৃত্তরা ঢুকে পড়েছে, আন্দোলন হাইজ্যাক হচ্ছে!
মাহবুবা সুলতানা শিউলি : সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।