রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

কালুরঘাট নতুন সেতু একনেকে পাস হচ্ছে কবে?

| প্রকাশিতঃ ২৫ জুলাই ২০১৮ | ৭:৫৭ অপরাহ্ন

.আলম দিদার : ২০২৩ সালেই প্রস্তাবিত কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন ও যানবাহন চলাচলের আশা করা হলেও এক অদৃশ্য কারণে বারবার তা পিছিয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগে ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনের অধীন একনেক কমিটির কাছে রেল মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হলেও একনেক সভায় উঠবে উঠবে বলেও সেটি আর উঠছে না। স্বয়ং রেলমন্ত্রী মুজিবুর হক গত জুন মাসে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকার কথাও জানালেও কার্যত সে ধরণের কোনো আলোর সন্ধান মিলছেনা।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, জুনের মতো জুলাই মাসের একনেক বৈঠকেও প্রকল্পটি পাস হবার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা। সেজন্য কালুরঘাট সেতু প্রকল্পটি দ্রুত একনেক বৈঠকে পাস হওয়ার জন্য রাজনৈতিক তদবির জোরদার করারও পরামর্শ দিয়েছেন রেল ভবনের এক কর্মকর্তা। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই সরকারের মেয়াদে কি আলোর মুখ দেখছে বোয়ালখালীবাসীর প্রাণের দাবি কালুরঘাট নতুন সেতু?

স্থানীয় সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদলও একাধিকবার সংসদে কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সেতুর জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন ‘কালুরঘাট সেতু বাস্তাবায়ন পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। তারা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। এতকিছুর পরও চলতি সপ্তাহের একনেক বৈঠকে কালুরঘাট সেতু প্রকল্পটি পাস হবার আশায় বুক বেঁধে বসে থাকলেও হয়তো এবারো নিরাশ হতে হবে বোয়ালখালীবাসীকে।

গত একনেক বৈঠকে প্রকল্পটি পাস না হওয়ার পর স্থানীয়রা আশা করেছিলেন চলতি সপ্তাহের একনেক বৈঠকে সেটি পাস হবে। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেল ভবনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পটির সব পেপার ওয়ার্ক সঠিকভাবে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে (একনেক) পাঠানো হলেও সেটি একনেক বৈঠকে কেন উঠানো হচ্ছে না বোধগম্য নয়। আসলে সব কিছু কর্মকর্তারাই করতে পারেনা। এসব বড় প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন এমপি মন্ত্রী বা শীর্ষ রাজনৈতিক লেভেলের তদবির। একটি প্রকল্পের পেছনে যদি যথাযথ তদবির বা তদারকি না থাকে সেটি যেমন সামনে যেতে পারে তেমনি পেছনেও যেতে পারে। এসব জনসম্পৃক্ত ও বড় প্রকল্পগুলোর পেছনে লেগে থাকতে হয়। ’

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধুমাত্র নগরের সঙ্গে বোয়ালখালীবাসীর যোগাযোগ মসৃণ করার জন্যই নয় এ প্রকল্প। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনেও কর্ণফুলী নদীর উপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতুর ভেঙে নতুন করে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। ২০১৮ সালের মার্চে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে নতুর সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন এবং যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সেতু আবার সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেল লাইনের অন্তর্ভূক্ত।

‘কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর একটি রেল কাম রোড সেতু’ নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ সেটি ঢাকায় রেলভবনে পাঠায়। পরে সেটি যাছাই বাছাই শেষে কয়েক দফা পুর্নগঠন করে গত ২৭ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে (একনেক) পাঠানো হয়।

একনেকে ডিপিপি অনুমোদন হলে কনসালটেন্ট নিয়োগ করার পর তারা ডিজাইন তৈরি করবে। ডিজাইন তৈরির পর বছর দেড়েকের মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এরপর ২০২০ সালের শুরুতে সেুতুর নির্মাণকাজ শুরু করে সেটি ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্পে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার যোগান দেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপম্যান্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

সূত্রমতে, প্রস্তাবিত এই সড়কসহ রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭২ কিলোমিটার। সেতুতে রেললাইনের দুই পাশের সংযোগ সড়কের প্রস্থ হবে ১০ দশমিক ৩ মিটার। সেতুর সঙ্গে ১ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার অভিগমন সড়কও নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পে কালুরঘাটে জানে আলী হাট রেলস্টেশন পুননির্মাণও অর্ন্তভুক্ত আছে। সেতুতে উঠানামার সময় বিদ্যমান সংকেতবাতি আধুনিকায়ন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ একটি পূর্ণাঙ্গ টোলপ্লাজা নির্মাণসহ সেতুর উপর রেললাইনের অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত আছে এই প্রকল্প প্রস্তাবনায়।

রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের যে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, সেটির সুফলও নির্ভর করছে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের উপর। কিন্তু কালুরঘাট সেতু দিয়ে যদি ট্রেন যেতে না পারে তাহলে এই প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। সারাদেশ থেকে নির্বিঘ্নে যাতে ট্রেন কক্সবাজারে পৌঁছতে পারে, সেজন্য কালুরঘাটে জরুরি ভিত্তিতে সেতু নির্মাণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, বৃটিশ আমলে নির্মিত বর্তমান কালুরঘাট সেতুর বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে কর্ণফুলী নদীর উপর অস্থায়ীভাবে একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেই সেতু তুলে নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতুটি শাহ আমানত সেতু নামে পরিচিত। কালুরঘাটে বিদ্যমান রেলসেতু ভেঙ্গে নতুন একটি সড়কসহ রেলসেতু নির্মাণের জন্য আন্দোলন করে আসছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী কালুরঘাট রেলসেতুটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এই সেতুর কারণে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেল যোগাযোগও বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো.আব্দুল মোমিন বলেন, ‘আমরা এখন সেতু বাস্তবায়ন নিয়ে আশাবাদী। তাই আর কোনো নেগেটিভ মন্তব্য করতে চাইনা। তবে রেলমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য দেওয়ার পরও কেন প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে উঠছে না সেটি বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো প্রভাব কাজ করছে কিনা চিন্তার বিষয়। এরপরও আশা করবো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবি শিগগিরই একনেক বৈঠকে প্রকল্পটি পাস করার মধ্য দিয়ে পূরণ করবেন। ’

প্রবাসী ব্যবসায়ী বোয়ালখালীর চরণদ্বীপের বাসিন্দা শাহেদ ইসলাম বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে শুনছি নতুন কালুরঘাট সেতু হবে হবে। কিন্তু এখনো সেই ধরণের আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আসলে আমাদের এমপি ও নেতাদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হয়ে জোর তদবির করে প্রকল্পটি পাস করিয়ে আনতে হবে। ’

বোয়ালখালীর আরেক বাসিন্দা তরুণ শিল্পপতি জসিম উদ্দিন সিআইপি বলেন, ‘গত এক দশকে সেতুটি করা হবে বলে বোয়ালখালীবাসীকে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। এবার নির্বাচনের আগে যদি সেতুর কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতি না আসে তাহলে সেটি নির্বাচনে ব্যালেটের মাধ্যমে দায়ী জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে জবাব দেবে জনগণ। বোয়ালখালীবাসীর প্রাণের দাবির সঙ্গে কোনো আপোস চলবে না। এর জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের থেকেও স্থানীয় এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের আরো তৎপর হতে হবে। ’

জানতে চাইলে কালুরঘাট নতুন রেল কাম সড়ক সেতুর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান বলেন, ‘গত একনেক বৈঠকে প্রকল্পটি পাস হবে আশা করা হলেও হয়নি। চলতি সপ্তাহের বৈঠকেও পাস হবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়। আমরা সবকিছু প্রস্তুত করে প্ল্যানিং কমিশনে পাঠিয়েছি। এখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা’

একুশে/এডি