বিএনপি নেত্রী পাপিয়ার অজানা কিছু তথ্য!

papiaরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছেন পাপিয়া। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আড্ডা দিচ্ছিলেন সহপাঠীদের সঙ্গে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সভাপতি হারুণ। তখন এক সহপাঠী সুদর্শন ছাত্রনেতা হারুণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন পাপিয়াকে। –মানবজমিন।

প্রথম দিন নাম-পরিচয় নিয়েই কথা হলো। এরপর প্রায়ই একসঙ্গে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। দুজনই একই মঞ্চে বক্তব্য রাখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই আড্ডা দিতেন একসঙ্গে। পছন্দ করতেন একজন আরেকজনকে। কিন্তু ভালো লাগার বিষয়টি কেউ কাউকে বলেননি। অন্য দশজন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ডেটিং করেননি। তাদের মধ্যে শুধুই ছিল রাজনৈতিক সম্পর্ক। কথা হতো দলের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে।

১৯৯৪ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনও শেষের পথে। তখন ছাত্রদলের নেতা-নেত্রীদের (আমান-সাবেরা, খোকন-শিরিন, ইলিয়াস-লুনা) বিয়ের হিড়িক পড়েছিল। ওই সময় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে দলের একটি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে অংশ নেন হারুণ-পাপিয়া।

ওই অনুষ্ঠানে তাদের দেখেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই সময় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আমিনুল হককে তাদের বিয়ে দেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে পাপিয়ার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান আমিনুল হক। হারুণকে বিয়ে করবে কিনা জানতে চান। রাজনৈতিক নেতা বিয়ে না করে চাকরিজীবী ছেলে বিয়ে করার কথা জানান পাপিয়া। তবে কিছুদিন পর পাপিয়া রাজধানীর মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নেন। বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি।

এ সময় যোগাযোগ করা হয় পাপিয়ার পরিবারের সঙ্গে। এরপর পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে ঠিক হয়। ’৯৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় দুই ছাত্রনেতা-নেত্রী। এরপর ছাত্রত্ব শেষ করে চাঁপাই নবাবগঞ্জেই শুরু করেন সংসার জীবন।

তিনবারের সাবেক এমপি হারুণ-অর রশিদের জন্ম ১৯৬২ সালে জানুয়ারিতে চাঁপাই নবাবগঞ্জে সদর উপজেলার চকআলমপুর গ্রামে। বেড়ে উঠেন সেখানেই। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন চাঁপাই নবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালে চলে আসেন রাজশাহীতে।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন শিরোইল উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপিরিমেন্টাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন রাজশাহী ডিগ্রি কলেজে। কলেজ পড়াকালে ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কলেজের ছাত্র সংসদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন।

১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন রাজশাহী বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। এর দুদিন পরই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আঁততায়ীর গুলিতে মারা যান।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। ৮৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। ৮৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ওই সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির পরপর তিনবার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। রাজপথে মিছিল-মিটিং সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। ’৯২ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় রিজভী-হারুণ পরিষদে রাকসু নির্বাচনে অংশ নেন। ছাত্রজীবন শেষে ফিরে যান নিজ জন্মভূমিতে। ’৯৬ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জ সদর আসন থেকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পান। ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ওই বছর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। এরপর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর দীর্ঘ ১৬ মাস কারাগারে ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পেলেও অল্প ভোটে হেরে যান। ২০০৯ সালের দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। এরপর সম্প্রতি দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। নির্বাচিত হন দলের যুগ্ম মহাসচিব। তবে রাজনীতি করেন ফুলটাইম। দলের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও এলাকায় থাকেন বেশি। রাজনীতি করতে গিয়ে মামলার শিকার হয়েছেন একডজনের বেশি।

এদিকে আলোচিত সাবেক ছাত্রনেত্রী সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়ার জন্ম ১৯৬৭ সালের ৩১শে মে নীলফামারী জেলার ডোমারে। তবে বাবার পৈত্রিক বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুরে। বাবা ছিলেন বিএডিসির এগ্রিকালচার অফিসার। বাবার চাকরির সুবাদে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কেটেছে শৈশব। বিএডিসি থেকে বাবা বদলি হয়ে চলে আসেন ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে।
সেখানে একটি স্কুলে ৯ মাস পড়াশোনা করেন তিনি। পরে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে বদলি হন। ’৭৪ সালে নর্থবেঙ্গল সুগারবেঙ্গল হাইস্কুলে ভর্তি হন। ওই স্কুলেই এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ’৮১ সালে তিনি তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। একদিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে শুনেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। ফিরে আসেন বাসায়। দেখেন অফিসপাগল বাবার মন খারাপ।
বাবা বললেন, দেশপ্রেমিক একটি মানুষকে মেরে ফেললো ঘাতকরা। পত্রপত্রিকায় শোক ছাপানো হয়। কিছুদিন পর আবদুলপুর সরকারি কলেজের ছেলেরা ছাত্রদলের নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য ফরম নিয়ে আসেন স্কুলে। জিয়ার প্রতি টান ছিল। স্কুলজীবনেই ফরম পূরণ করে ছাত্রদলের প্রাথমিক সদস্য হন। ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতিমনা ছিলেন পাপিয়া। স্কুলের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।

কবিতা আবৃতি, গান এমন কি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম হতেন। মঞ্চে বলতে পারতেন অনর্গল। সেই সুবাদে এলাকায় বেশ নাম-ডাক ছিল। একনামেই চিনতো এলাকার সবাই। ওই সময় আবদুলপুর সরকারি কলেজে ছাত্রদলের একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন। পরিবারকে না জানিয়ে অনেকটা গোপনে অংশ নেন ওই অনুষ্ঠানে।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা রুহুল কবির রিজভী। নবম শ্রেণীর ছাত্রী পাপিয়া বড় কোন অনুষ্ঠানে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। ছোট্ট পাপিয়ার জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনে উপস্থিত দর্শকরা মুহুর্মহু করতালি দেন। পাপিয়ার সাহসী বক্তব্য শুনে সম্মোহিত হন রিজভী। বাহবা দেন তাকে। তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এরপর এভাবে পরিবারকে না জানিয়ে গোপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন পাপিয়া। ’৮৩ সালে এসএসসি পাস করেন ভর্তি হন গোপালপুর কলেজে।

এদিকে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে একদিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অংশ নেন। আবদুলপুর না গোপালপুর কলেজ সরকারি হবে- এই নিয়ে বৈঠক করলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদসহ মঞ্চে উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা আবদুলপুর কলেজ সরকারিকরণের পক্ষে মত দেন। তৎকালীন কলেজ ছাত্রী পাপিয়া আচমকা মঞ্চে উঠে এর প্রতিবাদ জানান। উপজেলার নিকটতম হিসেবে গোপালপুরকে সরকারি করার দাবি জানান তিনি।

একপর্যায়ে পণ্ড হয়ে যায় ওইদিনের এরশাদের অনুষ্ঠান। ওই ঘটনার জেরে কলেজের চেয়ারম্যানকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রতিবাদে পরীক্ষা বর্জন করে সহপাঠীদের নিয়ে আন্দোলন নামেন পাপিয়া। আন্দোলনের চাপে একপর্যায়ে চেয়ারম্যানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সামরিক সরকার। ’৮৬ সালে এইচএসসি পাস করে প্রথমে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। পরে ভর্তি হন আইন বিভাগে।
উঠেন মুন্নুজান হলে। একই হলে থাকতেন বড়বোন। ডানপিঠে পাপিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য বড়বোনকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দেয় পরিবার। একবছর পর বোন পাস করে বেরিয়ে যান। এরপর হল পরিবর্তন করে উঠেন তাপসী হলে।

কিছুদিন পর ওই হলে ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ভিপি নির্বাচনে অংশ নেন। একমাত্র নারী নেত্রী ভিপি নির্বাচিত হন। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। টেলিভিশন বিতর্র্কে সবসময় প্রথম হতেন। সেজন্য বেশ সুনাম ছিল।
ছাত্রনেত্রী হিসেবেই সারা দেশে দলীয় বিভিন্ন সমাবেশে বক্তা হিসেবে অংশ নিতেন। এমনকি থানা পর্যায়ে কোন সভা-সমাবেশ হলেই ডাক পড়তো পাপিয়ার। ’৮৯ সালে দ্বিতীয়বার হলের ভিপি নির্বাচিত হন।

এরপর ছাত্রদলের রিজভী-ইলিয়াস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ’৯৪ সালে বিয়ের পর সংসার সামলানোর পাশাপাশি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা বারে পেশা জীবন শুরু করেন। ’৯৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে ডাকেন। দায়িত্ব দেন মহিলা দল গোছানোর। নির্বাচিত হন সংগঠনটির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
এরপর খুরশীদ জাহান হকের সঙ্গে সারা দেশে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা দলের বিভিন্ন কমিটি গঠনে চষে বেড়ান। ২০০৪ সালে খুরশীদ জাহান হকের মৃত্যুর পর মহিলা দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ওয়ান-ইলেভেনে জরুরি সরকারের আমলে স্বামী গ্রেপ্তার হলে চলে আসেন ঢাকায়। ২০০৯ সালে ঢাকা বারে প্র্যাকটিস শুরু করেন।
ওই বছরই জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। একইসঙ্গে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ওই বছরই সংরক্ষিত আসনে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ঝড় তোলেন সংসদে। সংসদের পাশাপাশি আদালত অঙ্গনেও ছিলেন সরব।

প্রতি ইস্যুতেই করতেন মিছিল-মিটিং। সেজন্য নারী নেত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০টি মামলার শিকার হয়েছেন। কারাবরণ করেছেন তিনবার। সর্বশেষ আন্দোলনে কোর্ট চত্বরে প্রতিবাদ মিছিলের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর দীর্ঘ ছয় মাস জেলে ছিলেন। তবে বাইরে রাজনীতি করলেও ঘরে এলে পুরোদস্তুর গৃহিণী। সংসার সামলান নিজেই। দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জনক হারুণ-পাপিয়া দম্পতি। বড় কন্যা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। দ্বিতীয় কন্যা ঢাকার একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। একমাত্র ছেলে একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।