ম্যাক্স হাসপাতালে অপারেশন, জীবন সংকটে পুলিশ সদস্য

শরীফুল রুকন : বুকের ওপর চাদর বিছানো। দুই পাশে বালিশ। মাথার নিচে আরেকটা বালিশ। কোন নড়াছড়া নেই তার। ব্যথার যন্ত্রণায় কাঁদছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে পুলিশ সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলমের শয্যাপাশে গেলে অস্ফুট স্বরে গোঙানি আর কান্না ছাড়া তার আর বলার মতো যেন কিছুই ছিল না।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের স্পেশাল রায়ট ফোর্সে (এসআরএফ) নায়েক হিসেবে কর্মরত জাহাঙ্গীর এখন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে পরপর তিনবার মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের (অপারেশন) সময় চিকিৎসকদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন জাহাঙ্গীর।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় পুলিশ হাসপাতালে গেলে নড়াছড়া তো দূরের কথা, স্বাভাবিক কথা পর্যন্ত বলতে পারছিলেন না জাহাঙ্গীর। তার দেখভালের জন্য দায়িত্বে ছিলেন এসআরএফের কনস্টেবল এনামুল হক; তিনি জানালেন, বিছানায় পড়ে থাকেন জাহাঙ্গীর। উঠে বসতে পারেন না। শারীরিক অবস্থা কিছুক্ষণ ভালো তো আবার খারাপ। এভাবেই একেকটি দিন কাটছে তার।

তবে গত সোমবার বিকেলে নায়েক মো. জাহাঙ্গীর আলমের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয় মুঠোফোনে। ৬ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের ওই কলে জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, অনেকদিন ধরে তার পিঠে কিছুটা ব্যথা ছিল। এজন্য সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন তিনি। এরপর চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানতে পারেন, তার মেরুদণ্ডে সমস্যা আছে। এরপর ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদের তত্ত্বাবধানে ম্যাক্স হাসপাতালে জাহাঙ্গীরের মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত ১০ এপ্রিল।

আগে থেকে অস্ত্রোপচারের জন্য ৫০ হাজার টাকা আর ম্যাক্স হাসপাতালের কেবিনে তিন-চারদিন থাকা বাবদ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধের কথা ছিল। এরপর ১৩ এপ্রিল ম্যাক্সে ভর্তি হন তিনি। ১৪ এপ্রিল জাহাঙ্গীরের মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। কয়েক দিন পর সেলাই কাটলে সেখানে পচন ধরে। এরপর ২২ এপ্রিল আবারও অস্ত্রোপচার করেন ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদ। ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ম্যাক্সে ভর্তি ছিলেন জাহাঙ্গীর, বিল করা হয় দুই লাখ টাকা।

এদিকে দুইবার অস্ত্রোপচারের পরও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। এরপর ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের স্বজনরা দেখা করলে তিনি বলেন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যন্ত্রণার কথা বললে তিনি বিরক্ত হন। পুলিশ, সাংবাদিক ও আইনজীবীর চিকিৎসা আর করবেন না বলেও জানিয়ে দেন ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদ। চিকিৎসকের এ ধরনের কথা বলার সময় নায়েক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী, বড় ভাইয়ের স্ত্রীসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

পরে যন্ত্রণায় কাতর হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরের প্রফেসর ডা. কামাল উদ্দিনের কাছে নেওয়া হয় নায়েক জাহাঙ্গীরকে। এ চিকিৎসকের পরামর্শে আবারও অস্ত্রোপচারের জন্য ম্যাক্সে ভর্তির সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ মে ম্যাক্সে আবারও ভর্তি হয়ে ৬ জুন পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন জাহাঙ্গীর। এরমধ্যে ডা. কামালের তত্ত্বাবধানে জাহাঙ্গীরের মেরুদণ্ডে আরেকদফা অস্ত্রোপচার হয়।

একের পর এক অস্ত্রোপচারে সুস্থতার বদলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে জাহাঙ্গীরের। গত সোমবার মুঠোফোনে কথা বলার সময়, জাহাঙ্গীর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন এই পুলিশ সদস্য।

এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার বিকেলে ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদ মুঠোফোনে বলেন, আপনি জাহাঙ্গীরের কী হন? কোথায় পেলেন এই অভিযোগ? অভিযোগ থাকলে গণমাধ্যমে লিখে দিতেও বলেন এই চিকিৎসক। পরক্ষণে তিনি বলেন, আপনি জাহাঙ্গীরের স্বজনদের নিয়ে আমার অফিসে আসুন, সামনাসামনি কথা বলবো। চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন অবহেলা ছিল না বলেও দাবি করেন ডা. আমিনুল ইসলাম আজাদ।

অন্যদিকে প্রফেসর ডা. কামাল উদ্দিনের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়, তবে তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে তার নাম্বারে এসএমএস পাঠিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করা হলেও সাড়া মিলেনি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সাধারণত কেউ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করি। তদন্ত শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ ঢাকায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিই। এরপর সেখান থেকে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। এখন পুলিশ সদস্য জাহাঙ্গীর যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে, তখন আমরা তদন্তের উদ্যোগ নেব।

তবে এখনই অভিযোগের বিষয়ে ভাবছে না নায়েক জাহাঙ্গীরের পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার ব্যয় যোগাতে গিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে তারা। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী গৃহিনী। দুই ছেলে-মেয়ে তাদের। কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি এলাকার স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে ছেলে ও মেয়ে পড়াশোনা করছে পঞ্চম শ্রেণীতে।

জাহাঙ্গীরের বড় ভাই রুহুল আমিন কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় পরিদর্শক পদে কর্মরত আছেন। জাহাঙ্গীরের অস্ত্রোপচারের বিষয় নিয়ে এখনই গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাননা তিনি। তবে রুহুল আমিন জানান, জাহাঙ্গীরকে ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করছেন তারা।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে জাহাঙ্গীরকে দেখে ফিরে আসতে বসা থেকে উঠতেই ঠোট নেড়ে পানি উচ্চারণের চেষ্টা করেন তিনি। পাশে থাকা একটি কাপে করে পানি দিতে গেলেই, অস্ফুট স্বরে গোঙানির মতো করে পুলিশ সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, ‘আমি তো মনে হয় আর বাঁচবো না!’