সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

মিতু হত্যা : চার্জশিটে উত্তর মিলছে মাস্টারমাইন্ড কে

প্রকাশিতঃ ৩ জুন ২০১৮ | ৭:১৯ অপরাহ্ন

.আলম দিদার : আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলাটি দু’বছর তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন শিগগিরই দেওয়া হবে চার্জশিট। সেটা মিতু হত্যা মামলার দুই বছর পূর্তির দিন ৫ জুনও হতে পারে, আবার এরপরও হতে পারে।

চার্জশিট প্রস্তুত! যে কোনো সময় আদালতে জমা পড়তে পারে চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলার চার্জশিট এমন ভাষ্য তদন্ত কর্মকর্তার হলেও গত বছরও সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার সহসা চার্জশিট দেওয়ার ঘোষণা দিলেও গত এক বছরেও জমা দিতে পারেনি চার্জশিট।

এদিকে চার্জশিটে মিতু হত্যার সঙ্গে জড়িত ‘খুনিদের’ অধিকাংশকে গ্রেফতার ও দুজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও খুনের ‘মূলহোতা’ মুছার হদিস এখনো দিতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। আর এ খুনের মাস্টারমাইন্ড কে সেটাও নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য নেই তদন্ত কর্মকর্তার।

তবে চার্জশিট আদালতে জমা হওয়া পর্যন্ত এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষায় থাকতে বলছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্তি উপ কমিশনার (উত্তর) কামরুজ্জামান।

তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত। খুব সহসা চার্জশিট যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে।’ সেটি কবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার দুই বছর পূর্তির দিন ৫ জুনও হতে পারে, আবার এরপরও হতে পারে। তবে সঠিক দিনক্ষণ এখনই বলতে পারছি না।’

মিতু হত্যা মমালা কেন? কার নির্দেশে এ খুন? আর প্রধান আসামি মুছাই বা কোথায় এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে কি প্রস্তুতকৃত চার্জশিটে? উত্তরে কামরুজ্জামান বলেন, ‘সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য চার্জশিট জমা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

গত ২০১৬ সালের বছরের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে খুন হন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। সে সময় পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন বাবুল। চট্টগ্রামে জঙ্গি দমন অভিযানের জন্য আলোচিত বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্ব থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় খুন হন তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু।

মোটরসাইকেলে করে আসা কয়েকজন সেখানে ছেলের সামনে তাকে প্রথমে ছুরিকাঘাত ও পরে গুলি করে হত্যা করে মিতুকে। হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন বাবুল আক্তার নিজেই। চট্টগ্রামে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততাও মিতু হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তবে অল্পদিনেই সে ধারণা থেকে সরে আসেন তদন্তকারীরা। ওই হত্যাকাণ্ডের পর এক মাসের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ওই বছরের ৫ জুলাই রাঙ্গুনিয়ায় নুরুল ইসলাম রাশেদ ও নুরুন্নবী নামে দুইজন পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। কিন্তু যাকে পুলিশ ওই হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ বলছে, সেই কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা এবং ‘হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া’ কালুর হদিস গত দুই বছরেও মেলেনি। তবে বারবার মুছার স্ত্রী দাবি করে আসছেন, মুছাকে ঘটনার পর পরই (২২ জুন ২০১৬) বন্দর থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। যদিওবা পুলিশ তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এমনকি সিএমপির পক্ষ থেকে মুছা ও তার সহযোগী কালুর সন্ধান পেতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেও তাদের হদিস মেলেনি এখনো।

হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা গুঞ্জনের মধ্যে ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে ঢাকার বনশ্রীতে শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেওয়ার খবর ছড়ালেও সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলছিলেন না। তার ২০ দিন পর একই বছরের ১৪ অাগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, বাবুলের অব্যাহতির আবেদন তার কাছে রয়েছে। আরও ২২ দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৬ সালের ২৬ জুন মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুইজনকে গ্রেফতারের কথা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তারা হত্যাকাণ্ডের মূল ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে মুছার নাম বলেছেন। আর হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি সরবরাহ করেন বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে পরিচিত নগরের বাকলিয়া এলাকার এহেতেশামুল হক ভোলা।

পুলিশের দাবি, মুছা এবং তার দুই সহযোগী নবী ও কালু মিতু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। এর মধ্যে নবী ও কালু ছুরিকাঘাত করেন বলে জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানিয়েছিলেন। পরে বাকলিয়া এলাকা থেকে ভোলা ও তার সহযোগী মনিরকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তলসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা পিস্তলটিই মিতু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয় বলে গোয়েন্দা পুলিশ সিআইডির ব্যালেস্টিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বলেছিলেন। ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভোলা ও রিকশা চালক মনিরকে আসামি করে অস্ত্রআইনে পৃথক একটি মামলা করা হয় বাকলিয়া থানায়। পরে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় ভোলাকেও। বর্তমানে ওই অস্ত্র মামলায় ভোলা ও মনিরের বিচার চলছে আদালতে।

তবে মিতু হত্যা নিয়ে যখন পুলিশ অন্ধকারে তখনই ২০১৬ সালের ১১ জুন নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে এক রিকশাচালক পাঁচলাইশ থানায় মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন মিতু হত্যার সঙ্গে রবিন জড়িত। তখন পুলিশ নগরের বায়েজিদের শীতলঝর্ণা এলাকার একটি আধাপাকা টিনের ছাউনির বাড়ি থেকে রবিনকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে মিতু হত্যা মামলায় ২০১৬ সালের ৭ জুন হাটহাজারীর মুসাবিয়া দরবার শরীফ থেকে আবু নছর গুন্নু নামের এক ব্যক্তিকেও সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গুন্নু জামিনে বের হলেও রবিনের পক্ষে কেউ জামিন আবেদন না করায় তিনি এখনো কারাগারে অন্তরীণ। মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘রবিন নির্দোষ। অভিযোগপত্র থেকে তাকে বাদ দেওয়া হবে। তখন মুক্তির ক্ষেত্রে তার আর কোনো বাধা থাকবে না।’

অন্যদিকে মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন প্রথম দিকে মেয়ের জামাতা বাবুল আক্তারের পক্ষে অবস্থান নিলেও পরে তার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের পেছনে জামাতার ‘পরকীয়া স্ম্পর্কের’ সন্দেহের ইংগিত করে তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তিনি এসব দাবি জানানোর পাশাপাশি ওই সময় সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন। বাবুল আক্তারের সঙ্গে উন্নয়নকর্মী গায়ত্রী সিং ও বনানী বিনতে বসির বর্ণি নামে দুই নারীর সম্পর্কের কথা বলেছিলেন তিনি। তবে উল্টো শ্বশুরপক্ষ তাকে ঘায়েল করতে চাচ্ছেন অভিযোগ করে সঠিক তদন্তেই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে বলে ওইসময় দাবি করেছিলেন বাবুল আক্তার।

এ বিষয়ে জানতে রোববার একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বাবুল আক্তারকে পাওয়া যায়নি। বার বার রিং হলেও তিনি ফোন ধরা থেকে বিরত থাকেন।

একুশে/এডি