শরীফুল রুকন: মো. রেজওয়ান ওরফে জুবায়ের (৫৫)। দেশের ইয়াবা নিয়ন্ত্রকদের অন্যতম তিনি। তবে তার নামে নেই কোন ধরনের মামলা। ২০১২ সালে ইয়াবা কারবার শুরুর পর এখন পর্যন্ত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আছেন এই শীর্ষ মাদক চোরাকারবারী। জীবনটা কাটাচ্ছেন বিলাসে গা ভাসিয়ে। সম্প্রতি তার একটি অভিজাত বাসায় গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের তো আক্কেলগুড়ুম!
পাঁচতলা বাড়ির নিচের দুইতলাকে ডুপ্লেক্স বানিয়ে থাকছেন রেজওয়ান। বিলাসবহুল ওই বাড়িতে যা যা থাকার কথা সবই আছে। নিচতলা পুরোটাই ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ছয়টি বেডরুম; সেখানে ডাইনিং রুম ও ছোট একটি ড্রয়িং রুমও আছে। পুরো বাড়িজুড়ে রয়েছে দামি আসবাবপত্র, বাতি। নিরাপত্তা নিশ্চিতের অংশ হিসেবে বাড়ির ভেতরে-বাইরে লাগানো হয়েছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এক ডজন সিসিটিভি ক্যামেরা।
ওই বাড়িতে অভিযানে যাওয়া নগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিজাত বাড়ি বলতে যা বুঝানো হয়, রেজওয়ানের বাড়িটি তেমনই। অভিযানের সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তার স্ত্রী-সন্তানরা ওই বাড়িতে থাকেন। রেজওয়ানের ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানা যায়, তারাও আগে থেকে বিষয়টি জানতেন। এ বিষয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই।’
গত ৩ মে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে সৎভাই মো. হাসানসহ আশরাফ আলীকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় আশরাফের জবানবন্দির প্রেক্ষিতে গত ১৬ এপ্রিল চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে রাশেদ ওরফে মুন্নাকে গ্রেফতার করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেফতার তিনজনের জবানবন্দিতে শীর্ষ ইয়াবা চোরাকারবারী হিসেবে মো. রেজওয়ান ওরফে জুবায়েরের নাম প্রথমবারের মতো ওঠে আসে। আগে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি। মো. আলম ও নুর আলম নামে দুই ভাগিনার মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করেন রেজওয়ান। ২০১২ সাল থেকে ইয়াবা চোরাকারবারে যুক্ত হন রেজওয়ান। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারেও তিনি জড়িত আছেন বলে তথ্য পেয়েছি আমরা।’
গ্রেফতার রাশেদ ওরফে মুন্না আদালতে জবানবন্দিতে জানান, মিয়ানমারের রেঙ্গুনের আবদুর রহিম তার ফুফাতো বোনের স্বামী। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ইয়াবা চোরাকারবার করছেন। রেজওয়ান সম্পর্কে রাশেদের চাচা। রহিমের কাছ থেকে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন রেজওয়ান। এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টি চালান রেজওয়ানের কাছে পাঠিয়েছেন রহিম। তিন বছর আগে বাংলাদেশে এসে রেজওয়ানের বাসায় রহিম কিছুদিন ছিলেন। ইয়াবা বিক্রির ১৪ কোটি টাকা রেজওয়ান থেকে পাওনা আছে রহিমের।
গ্রেফতার আশরাফ জবানবন্দিতে জানায়, গত বছরের ১৫ এপ্রিল পতেঙ্গার অদূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় একটি ট্রলার থেকে ২০ লাখ ইয়াবা জব্দ করে র্যাব। একই দিন নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি বাড়ি থেকে মো. মোজাহেরকে গ্রেফতার করা হয়। মোজাহেরের ট্রলারে করে ওই ২০ লাখ ইয়াবা রেজওয়ানের কাছে রহিম পাঠিয়েছিল। গত ৩ মে নগর গোয়েন্দা পুলিশ যে ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে সেগুলোর মূল মালিক আবদুর রহিম, রাশেদ ওরফে মুন্না ও মো. রেজওয়ান ওরফে জুবায়ের।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে বেড়ে ওঠেন রেজওয়ান। তার এক ভাই ব্যাংকার, আরেক ভাই দুবাই থাকেন। শুরুতে হুন্ডি ব্যবসায় নিজেকে জড়ান রেজওয়ান। ২০১২ সালের দিকে জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। ওই সময়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন মোজাফফর নগর এলাকায় ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির সামনে পাঁচতলা সুবিশাল বাড়ি তৈরী করেন রেজওয়ান। পুলিশ অভিযান চালানোর পর বাসাটিতে থাকেন না তিনি।
মোজাফফর নগরের যে স্থানে রেজওয়ানের পাঁচতলা বাড়িটির অবস্থান, তার পাশেই একই ধাঁচের আরও একটি ভবন আছে। হাজী ফয়েজ নামের এক ব্যক্তি ওই ভবনের মালিক। তবে পাশাপাশি এই দুই ভবনে চলাফেলার জন্য ছাদে রয়েছে ‘লুপ’। এক ভবনে অভিযান চললে অন্য ভবনে পার হতে পারবে যে কেউ।
তদন্ত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের একটি ভাড়া বাসার ঠিকানা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করেছেন রেজওয়ান। সে হিসেবে অনেক আগে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। এরমধ্যে এক ছেলে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। কয়েক বছর আগে কোটি টাকা খরচ করে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন রেজওয়ান। তার বাকি দুই ছেলে ও এক মেয়ে চট্টগ্রামে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে।
মেসার্স হোসাইন এন্টারপ্রাইজ নাম দিয়ে চট্টগ্রাম নগরের ডিটি রোডের পোস্তার পাড় ঠিকানায় একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন রেজওয়ান। তার নামে একটি আমদানি লাইসেন্সও আছে। তবে পুলিশ বলছে, এসব লোক দেখানো। ইয়াবা বিক্রি ও হুন্ডি ব্যবসা করেই তিনি কোটি টাকারও বেশী সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তার একাধিক বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। রেজওয়ান এখন এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন দানশীল ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘রেজওয়ান ইয়াবার গডফাদার। আগে তার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না। ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধারের মামলা তদন্তে নেমে তার ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়। ’
তিনি বলেন, ‘এই মামলা তদন্তে নেমে বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে তথ্য পাচ্ছি আমরা। যাদের নাম তদন্তে আসবে, প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলো সাধারণত বিলাসবহুল হয়। রেজওয়ানের বাড়িটিও সেরকম। অভিজাত বাড়িটিতে অভিযান চালিয়েছিলাম আমরা। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। রেজওয়ানকে ধরার চেষ্টা চলছে।’
একুশে/এসআর/এটি