সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ঘরে সোফা নেই টিভি নেই, তিনি এমপি’র পিএস!

প্রকাশিতঃ ৩১ মে ২০১৮ | ৭:০৭ অপরাহ্ন

.আজাদ তালুকদার, চন্দনাইশ ঘুরে এসে : প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় এমপি-মন্ত্রীর পিএস, এপিএস, পিএ মানে অর্ধএমপি, অর্ধমন্ত্রী! অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি তাদের কাছে লুটোপুটি খায়। তারা রাতকে দিন করেন, দিনকে রাত করেন!

এই সংস্কৃতির বিপরীতে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন এক পিএস, যিনি অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র, একেবারে আলাদা। অতি সাদামাটা, সরল, নির্লিপ্ত জীবনযাপনকারী এমপি’র এ পিএস-এর নাম সুব্রত বড়ুয়া। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-আংশিক সাতকানিয়া) আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরীর একান্ত সচিব (পিএস) তিনি।

ডিএইচএল-এর মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আয়েশি চাকরি ছেড়ে এমপি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর অনুরোধে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি তাঁর পিএস হিসেবে যোগ দেন সুব্রত বড়ুয়া। এর আগে ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর ইউসিবিএল ব্যাংক-চেয়ারম্যানের একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ব্যাংক-চেয়ারম্যান প্রয়াত জাফর আহমদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, হাজী ইউনুছসহ ৮ জন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয় তার।

এরপর ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ঢাকায় জাফর আহমদ চৌধুরীর মালিকানাধীন একটি বায়িং হাউজে চাকরি করেন। পাশাপাশি রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় একটি মোবাইল এক্সেসরিসের দোকান খোলেন। বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ইয়্যুথ ফেডারেশনের সহ সভাপতি নিযুক্ত হন এই সময়টাতেই।

সবকিছু গুটিয়ে ২০০৬ সালে যোগ দেন ডিএইচএল-এর কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ হিসেবে। বেতনের বাইরে বছরে চারটি বোনাস, একবার ইনক্রিমেন্ট, বার্থডে উইশ, দুই জোড়া জুতা, বেল্ট, প্যান্ট-শার্টসহ পেতেন আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু কথিত সুখের এই দিনগুলোতে অতীত-ট্র্যাজেডি মনে পড়লে সবকিছু মিছে, ফিকে মনে হয় সুব্রত বড়ুয়ার।

১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, চন্দনাইশের স্থানীয় সাংসদ কর্নেল অলি আহমেদের ভাগিনা আবদুল মাবুদের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী জ্বালিয়ে দেয় সুব্রত বড়ুয়ার পৈত্রিক বাড়ি, জীবন্ত পুড়িয়ে মারে তার বাবা সুদর্শন বড়ুয়াকে। সেদিন ভাগ্যক্রেম বেঁচে যান সুব্রত, তার অসুস্থ ভাই এবং মা নিরুপমা বড়ুয়া।

সুব্রত বড়ুয়ার পরিবারের সবাই কট্টর আওয়ামী লীগার। গাছবাড়িয়া কলেজে ছাত্রলীগ করার সময় সুব্রতের ঈর্ষন্বীয় সাংগঠনিক শক্তি-ভিত্তিই টার্গেটের মূল কারণ। তাই কর্নেল অলির সন্ত্রাসীরা সপরিবারে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল সুব্রতেক। এরপর সেই দুঃসহ ক্ষত সঙ্গী করে বইয়ে চলা সুব্রত বড়ুয়া তার ‘জীবনতরী’ ভেড়াতে চেয়েছিলেন সততা ও মানবপ্রেমের ঘাটে। যেখানে থাকবে না বিলাসব্যসন, ব্যক্তিজীবন। সাংসারিক জীবনে না জড়ানোর শপথ একসময় ভাঙতে হলো ৩৭ বছর বয়সে বিয়ে করে। তার ৯ বছরের সংসারে এখন তিনকন্যা- প্রতীক্ষা, প্রতিষ্ঠা ও কনিষ্ঠা।

সুব্রত’র ভাষায় ‘তিন’ পৃথিবী। এই ত্রি-পৃথিবীই এখন তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, এই অনুপ্রেরণা সঙ্গী করে এমপি স্যারের সতত সৎ চিন্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভালোই আছি। কী পেয়েছি, কী পাইনি- সেই হিসাব কষি না। ‌’ত্যাগই সুখ’কে যারা জীবনের ব্রত করে তাদের কাছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কিংবা বৈষয়িক ভাবনা নস্যি। আমার এলাকার এমপি তদুপরি সততার পাঠশালায় চূড়ান্ত উত্তীর্ণ একজন মানুষের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়া সেদিন আমার পক্ষে কঠিনই ছিল। তাই ভালো বেতন, ভালো সুযোগ-সুবিধার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে এমপি স্যারের কাছে চলে আসি। পরিবারের কারো সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজনও মনে করিনি। এ কারণে আমার স্ত্রী বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন, অনেকদিন বকাবকিও করেছিলেন আমাকে। পরে তাকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছি যে, আমার কাছে আয়েশী জীবনযাপনের চেয়ে এমপি স্যারের সৎ, নির্মোহ, নির্লোভ পথচলার সারথী হওয়া অনেক বেশি আনন্দের। গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ব্যক্তিগত চাহিদার পরোয়া না করে চন্দনাইশ-সাতকানিয়ার মানুষকে ‘বুঝতে’ চেষ্টা করেছি। নিরন্তর পাশে থেকেছি পিএস নয়, সাধারণ মানুষ হিসেবে। পিএস-এর সংজ্ঞা কী, আমি জানি না। এ পদের নাকি অনেক ক্ষমতা, অনেক শক্তি-কিন্তু সেসব আমি কিছুই জানি না। এ পদকে পুঁজি করে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের অঙ্কটাও আমার শেখা হয়নি।

.সরকারিভাবে যা বেতন পাই, তা দিয়ে আমার সংসার চলে। ডিএইচএল-এর চাকরি ছাড়ার সময় ৭ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। গত সোয়া চার বছরে সংসারে ঘানি টানতে এই টাকা আমাকে অনেক বেশি সহায়তা করেছে। -বলেন সুব্রত।

সুব্রত বড়ুয়া বর্তমানে স্ত্রী, তিনকন্যা নিয়ে ১৪ হাজার টাকায় নগরের লাভলেইনে রহমান চেয়ারম্যানের বাসায় ভাড়া থাকেন। এটাই তার এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি ভাড়ার ঘর। এর আগে কখনো ৮-১০ হাজার টাকার বেশি ভাড়ার বাসায় খাকেননি। পরিবার বড় হওয়ায় কিছুদিন হলো এ বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সুব্রত বড়ুয়ার বাসায় কোনো সোফা নেই। নেই আধুনিক টেলিভিশন। ৮ বছর বয়সী তার বড় মেয়ে বাওয়া স্কুলে পড়ে। মেয়ের পড়াশোনার খরচ, দুগ্ধপোষ্য বাকি দুই কন্যার ভরণপোষণ, মাসশেষে ঘরভাড়া মিটিয়ে তার হাতে আর কোনো টাকা অবশিষ্ট থাকে না। মা থাকেন চন্দনাইশের বরমা গ্রামের বাড়িতে। মায়ের থাকার ঘরে অ্যাটাচ বাথরুম করার অনেকদিনের ইচ্ছাটাও পূরণ হয়নি সুব্রত বড়ুয়ার।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মায়ের বাথরুমটা প্রতিদিনই করি। কিন্তু করা হয়ে উঠে না। টাকা নিয়ে বের হলে রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে পকেটে আর টাকা থাকে না। প্রায় প্রতিদিনই চন্দনাইশ যেতে হয়। গরীব-দুঃস্থ সামনে পড়ে গেলে না করতে পারি না। হাতখোলা স্বভাব আমার। পকেটে যা থাকে দিয়ে আসি। এতে একধরনের শান্তি পাই। বলেন সুব্রত।

সুব্রত বড়ুয়ার এমন সাদামাটা, সৎ জীবনযাপন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চন্দনাইশ সংসদীয় আসনের এমপি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বুধবার রাতে একুশে পত্রিকাকে বলেন, সুব্রত বড়ুয়ার মতো বাংলাদেশে আর কোনো এমপি’র পিএস আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন সৎ ছেলে আমার জীবনে দেখিনি। আমার চেয়েও অনেক বেশি সৎ সে। এলাকায় আমার চেয়েও জনপ্রিয়, আমার এলাকার মানুষ তাকে খুব পছন্দ করে।’

.তিনি বলেন, ‘বেতনের বেশিরভাগ টাকা সে আমার এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে আমার হয়ে বিলিয়ে দেয়। এসব খরচের হিসাব রেখে দিনশেষে আমার কাছ থেকে মিটিয়ে নেয়ার কথা বললে সে কখনো তা করে না। এজন্য আমি তাকে বকাবকি করি। বলি, তোমার বউ-বাচ্চার হক কেন তুমি এভাবে বিলিয়ে দিচ্ছো। সে এসব শোনে না। আমার আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, কোনো ধর্মে এমন বিরল চরিত্রের ছেলে আমি দেখিনি। এটা আল্লাহর রহমত। আল্লাহ-প্রদত্ত এ দায়িত্ব শতভাগ সততার সঙ্গে পালনে একটা ভালো ছেলে তিনি আমাকে মিলিয়ে দিয়েছেন।’

এমপি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পিএসরা গাড়ি-বাড়ি কত কিছুই করে। সুব্রত তার পুরো বিপরীত। তাকে কেউ এককাপ চা খাওয়াতে পারে না। তার ছোট ছোট সন্তানরা গরমে কষ্ট পায়, সে আইপিএস কিনতে পারে না। আমি জোর করে তার বাসায় আইপিএস পাঠিয়েছি। আমি বিদেশে গেলে তাকে বলি, তুমি কোথাও বেড়াও, আমার গাড়ি ব্যবহার করো। সে তাও করে না। অদ্ভুত এক ছেলে!’

চন্দনাইশের সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ মানিক বলেন, আমরা অনেক সৌভাগ্যবান। একজন সৎ, নিবেদিতপ্রাণ এমপি’র পাশাপাশি অসম্ভব রকমের সৎ একজন পিএস পেয়েছি। কোনো প্রলোভন তাকে (পিএস) স্পর্শ করতে পারে না। চন্দনাইশের কেউ তাকে কখনো এক কাপ চা খাওয়াতে পেরেছে এমন নজির নেই।

ভুট্টো নামে চন্দনাইশ দোহাজারির আরেক বাসিন্দা বলেন, এমন ধৈর্য, সহনশীল মানুষ আমরা কখনো দেখিনি। সবসময় পিএস সাহেবের মুখে হাসি লেগে থাকে। কাউকে কখনো ‘না’ করেন না। এমপি সাহেবের পক্ষ হয়ে সাধ্যমতো মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। কাজে না পারলে, কথায় কমফোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি।

একুশে/এটি