যুগ্মসচিব পদমর্যাদার হয়েও তিনি চলেন পুলিশ প্রটোকল, গানম্যান নিয়ে!

চট্টগ্রাম : সরকারের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হয়েও পুলিশ প্রটোকল ছাড়া এক মুহূর্তও চলেন না চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম। যেখানেই যান তার সামনে-পেছনে থাকে গাড়িবহর, প্রটোকলের দায়িত্বে থাকেন একজন এএসআইয়ের নেতৃত্বে চার পুলিশ। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় থাকেন একজন গানম্যানও।

বছরের পর বছর চট্টগ্রামের রাজপথ কাঁপিয়ে মন্ত্রীস্টাইলে সিডিএ চেয়ারম্যানের এই চলাফেরাকে ভালোভাবে দেখছেন না সচেতন মহল।

সচেতন মহলের অনেকেই বলছেন, এমনিতে সিডিএ চেয়ারম্যান নিজেকে সাদামাটা, বাহুল্যবিবর্জিত সাধারণ একজন কর্মী বলে দাবি করেন সবসময়। কিন্তু বাস্তবে তিনি শোডাউন ও আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী। ছোট একটি পদে থেকে প্রটোকল ছাড়া এক মুহূর্তও চলেন না। এটা তার স্ববিরোধী আচরণ এবং প্রকারান্তরে ব্যক্তি-অভিরুচিরই বহিঃপ্রকাশ।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুযায়ী রাষ্ট্রের ২৫টি পদের ক্রমবিন্যাস রয়েছে। সেই ক্রমবিন্যাসে শীর্ষে আছেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় এবং জাতীয় সংসদের স্পীকার রাষ্ট্রের তৃতীয় মর্যাদাশীল ব্যক্তির পাশাপাশি সর্বশেষ ২৫ তম ব্যক্তির তালিকায় আছেন পুলিশ সুপার (এসপি), সিভিল সার্জন, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং প্রথম শ্রেণীর পৌরসভার মেয়র।

ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের এই ক্রমবিন্যাসে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদটির অবস্থান ২২ তম। একই অবস্থানে আছেন বিভাগীয় কমিশনার, আইজি প্রিজন, ডিআইজি, চা-বোর্ডের সদস্য, স্বাস্থ্যবিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক, সরকারের যুগ্মসচিব এবং এই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা।

সিডিএ চেয়ারম্যানের নিরাপত্তায় একজন এএসআই (সশস্ত্র) এর নেতৃত্বে তিনজন কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে। প্রতি এক মাস পরপর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব বদল হয় বলেও জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ছালাম সাহেবের সঙ্গে থাকার জন্য পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ আছে। এটাকে ‘লোভনীয় পদ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তার প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি আর্থিকভাবে খুশি করা হয়। এর বাইরে ছালাম সাহেবকে দিয়ে নানা তদবিরের বিষয়ও থাকতে পারে, যার কারণে ওই দায়িত্ব পালন করতে রীতিমত তদবির করেন কেউ কেউ। পুলিশ সদস্য হিসেবে সরকারি বেতন-ভাতাদি তো আছেই।

আব্দুচ ছালামের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্যরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ে সিডিএ’র পিকআপ ভ্যানটি সেখানে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে আসেন। কখনো সকাল ১০টা, আবার কখনো সকাল ৭টায়ও দায়িত্বপালনে বের হন তারা। রাতে কখনো ১১টার মধ্যে পুলিশলাইনে ফিরেন পুলিশ সদস্যরা।

অভিজ্ঞমহলের মতে, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় থেকে সরকারি বেতনভুক্ত চার পুলিশ সদস্যকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ব্যবহার করতে পারেন না সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম। তার এতই খায়েস থাকলে কোনো সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে নিজের অর্থে ৪ জন নয়, ১০ জনও পাহারায় রাখতে পারেন না। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা কম। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ৭ হাজার মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন একজন পুলিশ। রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তায় পুলিশ-সঙ্কটের এই পরিস্থিতিতে ৪ জন পুলিশকে একজন ব্যক্তির পাহারায় নিয়োজিত করা পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় জনবল ও অর্থের অপচয়, অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য অনেকের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর বিশেষ শাখার উপ পুলিশ কমিশনার মোখলেসুর রহমান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শেষে তিনি বলেন, ‘কারো আবেদনের প্রেক্ষিতেও আমরা পুলিশ প্রটোকল দিই, আবার নিরাপত্তার সংশয় তৈরি হলেও নিজ থেকে প্রটোকল দিয়ে থাকি।’ আবেদনের প্রেক্ষিতে সিডিএ চেয়ারম্যানকে পুলিশ প্রটোকল দেয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ভাই এর বেশি কিছু জানতে চাইলে আমাকে দেখে বলতে হবে।’

সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপর হুমকি থাকলে সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে আমরা পুলিশ প্রটোকল কিংবা গানম্যান দিয়ে থাকি। এ কারণে হয়তো সিডিএ চেয়ারম্যান প্রটোকল পাচ্ছেন। সিডিএ চেয়ারম্যানের এ ধরনের কোনো হুমকি জানা মতে নেই- এমন প্রশ্নে আমেনা বেগম বলেন, আপনি যেহেতু জানালেন বিষয়টি আমরা আরো খতিয়ে দেখবো।’

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর কেন্দ্রীয় সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদােরর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মঙ্গলবার রাতে একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। যে যেটা পাওয়ার নয়, সেটা পাচ্ছে। যার ক্ষমতা আসে সে ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে কোনো নিয়মপদ্ধতি না মেনে। এগুলোর পরিণতি কখনো মঙ্গল নয়।’

সিডিএ সূত্র জানায়, আবদুচ ছালাম ছয় দফায় নয় বছর সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম মেয়াদে দুই বছরের জন্য আবদুচ ছালামকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। তিনি ওই বছরের ২৮ এপ্রিল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে দুই বছর, ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ তৃতীয় মেয়াদে এক বছর, ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল চতুর্থ মেয়াদে এক বছর এবং ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল পঞ্চম মেয়াদে দুই বছর এবং ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল ষষ্ঠবারের মতো দুবছরের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় আব্দুচ ছালামকে। প্রথমবার চেয়ারম্যান নিয়োগের কয়েকমাস পর থেকেই আব্দুচ ছালাম রাষ্ট্রের এই প্রটোকল ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার রাতে এ ব্যাপারে টেলিফোনে কথা হয় সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামের সঙ্গে। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি কখনো নিজ থেকে পুলিশ প্রটোকল চাইনি। আমাকে দেয়া হচ্ছে। সরকার যদি আমাকে এই সুবিধা দেয় আমার কী করার আছে।’

আপনারা জানেন, আমি শোডাউন, আত্মপ্রচারে বিশ্বাস করি না। এসব আমার দরকারও নেই। দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। দলের লোকজন, সাধারণ মানুষই আমার বড় পাহারাদার বলে মনে করি। বলেন সিডিএ চেয়ারম্যান।

ছবি : আকমাল হোসেন

একুশে/এসআর/এটি