শরীফুল রুকন : চট্টগ্রাম নগরের ডিশ ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার দুই আসামির সঙ্গে চকবাজার থানার ওসি মীর নুরুল হুদা ও বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরীর ছবি পাওয়া গেছে; খুনের ঘটনায় এই দুই আসামিসহ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
গত শুক্রবার বিকেলে ডিশ সংযোগের ব্যবসার দখল নিয়ে নগরের মিয়ার বাপের মসজিদ এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এম মুছা এবং যুবলীগের কর্মীদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে মারা যান ফরিদুল ইসলাম ও স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয়ে আহত হন ৯ মাসের শিশুসহ চারজন।
এ ঘটনায় চকবাজার থানায় শুক্রবার রাতে নিহতের স্ত্রীর দায়ের করা মামলার ৯ আসামির মধ্যে রয়েছেন- সাবেক মন্ত্রী ও প্রয়াত এম এ মান্নানের শ্যালক ও আওয়ামী লীগ নেতা এম এম মুছা। বাকি আসামিরা হলেন- মো. ফয়সাল, মো. মাসুদ, মো. মুরাদ, তৌহিদুল আলম, মো. রাসেল, ইকবাল হোসেন, মো. নবী ও জানে আলম।
অভিযোগ আছে, হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী। সরকারদলীয় রাজনীতির সুবাদে তাদের সাথে সখ্যতা রয়েছে পুলিশের বেশ কিছু সদস্যের। যার কারণে তারা গ্রেফতার হচ্ছেন না।
পুলিশের সাথে অধরা আসামিদের ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের’ অভিযোগের কিছুটা প্রমাণও একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
কমিউনিটি পুলিশিং ডে- উপলক্ষে গত বছরের ২৮ অক্টোবর সকালে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম থেকে দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠ পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। র্যালিতে নিজের থানা এলাকার কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের নিয়ে অংশ নেন থানার ওসিরা।
সেদিন চকবাজার থানার ওসি মীর নুরুল হুদার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গেছে ফরিদুল হত্যার অন্যতম আসামি ফয়সালকে; একই ছবিতে দেখা গেছে বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরীকে। আর দুই ওসির মাঝখানে দেখা গেছে ফরিদুল হত্যার আসামি মাসুদকে।
২৮ অক্টোবর এমএ আজিজ স্টেডিয়াম এলাকায় তোলা পৃথক আরেকটি ছবিতে কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের দলের অগ্রভাবে থাকা ওসি মীর নুরুল হুদার পাশে দেখা গেছে হত্যার আসামি ফয়সালকে।
পৃথক আরেকটি অনুষ্ঠানে ওসি মীর নুরুল হুদার সাথে ফয়সালের ছবি পাওয়া গেছে; ওই ছবিটি দামপাড়া পুলিশ লাইনের মাল্টিপারপাস শেডে তোলা বলে জানিয়েছেন পুলিশের একাধিক সূত্র।
ফরিদুল খুনের অন্যতম অভিযুক্ত ফয়সালের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকে খুনসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার রেকর্ড আছে পুলিশের কাছে। ২০১৪ সালের ৪ মে রাতে ছিনতাইকালে বাধা দিয়ে খুন হন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়াসির আরাফাত ইমন। এ খুনের প্রধান আসামি ছিল ফয়সালকে ওই বছরের গত ৬ জুন গ্রেফতার করে বাকলিয়া থানার পুলিশ।
বাকলিয়া থানার তালিকাভুক্ত এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সে সময় হত্যা, ছিনতাইসহ পাঁচটি মামলা ছিল। ইমন হত্যাকান্ডের দুই মাস আগেও তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে ইমন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত এই আসামি পরে জামিনে বের হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
খুনের মামলার আসামির সাথে ছবি তোলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন চকবাজার থানার ওসি মীর নুরুল হুদা; তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ছবিটি যখন তোলা হয়েছে, তখন তো তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না। কমিউনিটি পুলিশিং ডে তে এলাকার লোকজন গিয়েছিল, তারাও গিয়েছিল। তারা ছবি তুলেছে, কিন্তু তখন তো তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না।’
ফয়সালের বিরুদ্ধে ইমন খুনে জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরার পর ওসি নুরুল হুদা বলেন, ‘সেটা আমার থানায় না, সেটা বাকলিয়া থানায়। ফয়সালের বিরুদ্ধে আমার থানায় আগে অভিযোগ ছিল না। আমার থানায় অভিযোগ থাকলে আমি ছবি তুলতাম না। কমিউনিটি পুলিশের অনুষ্ঠানে তারা গেছে, ছবি তুলেছে। তখন তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না।’
দুই জায়গায় ধরতে পুলিশের দল পাঠিয়েছেন উল্লেখ করে ওসি নুরুল হুদা বলেন, তারা এখন পার পাবে না। দুই একদিনের মধ্যে তারা ধরা পড়বে।
বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমি তো ফয়সাল ও মাসুদ নামে কাউকে চিনি না। এটা তো চকবাজার থানার ঘটনা। আমি এরকম কিছু জানি না। কোন অনুষ্ঠানে গেলে অনেকেই তো ছবি তুলে। দাঁড়িয়ে থাকে ছবি তোলে, মাস্তান না ক্রিমিনাল এসব তো খেয়ালই থাকে না অনেক সময়। স্বাভাবিকভাবে যে কেউ এভাবে ছবি তুলতে পারে। আমার সাথেও এভাবে কেউ তুলেছে। সে একসময় সন্ত্রাসী, মাস্তান, খুনের আসামি হবে সেটা আমি জানলে তো ছবি তুলতাম না। তাদেরকে আমি চিনি, সম্পর্ক আছে, সেজন্য ছবি তুলেছি, বিষয়টা সেরকম না।
এদিকে ফরিদুল খুনের ঘটনায় আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়েছে। সেখানে নিহতের মেয়ে ফারহানা আকতার জারা বলেন, ‘বাবার হত্যাকারীদের পুলিশ এখনো গ্রেফতার করেনি। আমার বাবা যুবলীগের রাজনীতি করতেন। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা কী বিচার পাবো না?’
মানববন্ধনে অন্যন্যের মধ্যে নিহত ফরিদুলের মা সালেহা খাতুন, স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবু তালেব, মনোয়ার হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে জানান, ঘটনায় জড়িত ও ভুক্তভোগী সবাই নানা অপরাধে জড়িত। তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ও আছে। নিহত ফরিদুলের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা ছিল। অস্ত্র মামলায় সাজা ভোগ করে দেড় মাস আগে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
তিনি আরও জানান, হত্যার ঘটনায় একনলা বন্দুকের পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে রিভলবারও। খুনের ঘটনাটি রিভলবারের গুলিতে হয়েছে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। রিভলবারটি কে ব্যবহার করেছে তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
এদিকে হত্যার আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। এ নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না। আসামিরা আইনের আওতায় না এলে আগামিতে আরও বড় ধরনের ঘটনার আশংকা করছেন ডিসি রোড়ের বাসিন্দারা।
এসআর/এটি/একুশে