চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। দুই পদে যেতে চান ৩৮ জন নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে যেমন আছে পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতাকর্মী, তেমন রয়েছে টেন্ডারবাজ, অপহরণকারী, খুন ও অস্ত্রমামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী, চুরি-ছিনতাইয়ে অভিযুক্তরা।
চবি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচনের বিষয়ে সুপারিশ করার কথা রয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থীদের ২১ জনের তালিকা জমা পড়েছে তার হাতে। এ তালিকায় অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতে ঠাঁই পেয়েছে নানান অপরাধে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ এম ফজলে রাব্বী সুজন নিজেই সভাপতি হতে প্রার্থী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আড়াই বছরে শত কোটি টাকার টেন্ডারবাজির অভিযোগ। এ ছাড়া তিনি অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। আড়াই বছর ধরে কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
দীপ্ত সিং নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সুজন ভাই সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসে তার নিজস্ব বলয় তৈরি করার জন্য শিবিরের চিহ্নিত কর্মী ও ছাত্রফন্টের চবি শাখার সাধারণ সম্পাদককেও ছাত্রলীগের পদ দিয়েছে। তাপস সরকার হত্যা মামলার আসামিদের পদ দিয়েছে। বর্তমানে তিনি নিজেও সভাপতি প্রার্থী। তার সাথে থাকা চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদক ব্যবসায়ীদেরও প্রার্থী বানিয়েছে। নাছির ব্লকের একাকার গ্রুপের সদস্য মুন্তাসির মুনির মুন ও বিবাহিত সহ সভাপতি আল মোকাররম পলাশকে তিনি প্রার্থী বানিয়েছেন।’
মিথুন পালিত নামে অপর এক কর্মীর অভিযোগ, সাধারণ সম্পাদক পদটি ব্যবহার করে সুজন ভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান প্রত্যেকটি নির্মাণ কাজের মূল টাকার ২ শতাংশ হারে চাঁদা আদায় করেছেন। এ টাকার ভাগ নিয়ে গ্রুপের মধ্যে বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমানে তিনি ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ভবনের একটি কাজ করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। অর্থাৎ সংগঠনকে বিক্রি করে তিনি এতোদিন ব্যবসাই করেছেন।
পিয়াস সরকার নামে এক কর্মীর অভিযোগ, ‘বারবার কর্মীদের কাছ থেকে সিভি নিয়ে সুজন হল এবং ফ্যাকাল্টি কমিটি করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তিনি টাকার বিনিময়ে শুধুমাত্র শিবির নেতাকে শিক্ষক বানানোর জন্য বিবিএ ফ্যাকাল্টির কমিটি গঠন করেন। পরে ওই শিবির নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানান তিনি। তার এ সকল ব্যর্থতা ও অপকর্মের কারণে কমিটি দুইবার স্থগিত ও অবশেষে বিলুপ্ত করা হয়।’
পিয়াস সরকার একুশে পত্রিকাকে আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন ভাইয়ের লিখা বই কেনার জন্য সুজন ভাই টেন্ডারের টাকা থেকে এক লাখ টাকা কেটে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে ওই বই কেউ চোখেও দেখিনি। টেন্ডারের টাকায় জাকির ভাইয়ের বই কিনে রাজনীতি করা মানে তিনি সংগঠনকে বিক্রি করে ব্যবসা করেছেন। যার মাধ্যমে ছাত্রলীগের ঐতিহ্যকে তিনি কলংকিত করেছেন। আমরা কেন্দ্রের প্রতি অনুরোধ জানাই এ ধরনের অপকর্মের সাথে লিপ্ত কাউকে যেন নের্তৃত্ব দেওয়া না হয়।’
সঞ্জয় দত্ত নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জোবরা গ্রামের জামায়াত নেতা আবুল হাসেমের দুই ছেলে সালাউদ্দিন ও আলাউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি নিয়ে দেয় সুজন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী হলে চাকরী পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে চবি মেডিকেল ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে কামরুল হাসানের কাছ থেকে সুজন ৫ লক্ষ টাকা নেয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর থেকে একটি কর্মী সভার আয়োজন করতে পারেনি। তিনি টাকার ইনকামের জন্য এ পদটি ব্যবহার করেছেন প্রতিনিয়ত।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের বই টেন্ডারবাজির টাকায় কেনা নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফজলে রাব্বী সুজন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সাংগঠনিক কোন কথাবার্তা হয়েছে? টেন্ডারের টাকা আমি কার কাছ থেকে নেব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না! আমি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, আমি বই কেনার জন্য কারও কাছ থেকে টেন্ডারের টাকা নেব, এটা আবার জুনিয়ররা পায় নাই, ব্যাপারগুলো কেমন না? আপনি আমাকে যে প্রশ্নটা করেছেন, সেটা যৌক্তিক কিনা, চিন্তা করেন!’
পরক্ষণে সুজন বলেন, ‘আমাদের জাকির ভাই বই লিখেছে, এটা ওই একুশে বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বই। আমরা এই ইউনিটে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যারা ছিলাম, আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বই কিনেছি এবং তা নেতাকর্মীদের মাঝে বিতরণ করেছি। এতটুকুই।’
জামায়াত নেতা আবুল হাসেমের দুই ছেলে সালাউদ্দিন ও আলাউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি ও চাকরি দেওয়ার কথা বলে কামরুল হাসানের কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা নেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে ফজলে রাব্বী সুজন বলেন, ‘কোন সালাউদ্দিন? আলাউদ্দিন? এই নামে আমি কাউকে চিনি না। এবং চাকরি দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমার সকল কার্যক্রম ছিল ছাত্রদের ঘিরে। আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার না যে আমি কাউকে চাকরি দেব।’
সুজন বলেন, ‘সামনে কমিটি হচ্ছে। নিজেদের অজান্তে মনে করতেছে যে, সুজন ভাই দায়িত্বে আসতেছে কিনা, ভাইকে একটু বিতর্কিত করি…। কিন্তু আসলে এমন কিছু না…!’
এ প্রতিবেদককে এসব বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন না করার অনুরোধ জানিয়ে সুজন বলেন, ‘এসব তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ, না করলেও চলবে!’
এ দিকে চবি ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী ২০০৮-০৯ সেশনের ছাত্র মুনতাসির মুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ‘একাকার’ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এ গ্রুপটি চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আজম নাছিরের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করে। গ্রুপ পাল্টে মুনতাসির মুন বর্তমানে সুজনেরই আস্থাভাজন হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
সভাপতি প্রার্থী এস এম জাহিদুল আওয়াল ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী। সদ্য বিলুপ্ত কমিটির অর্থ সম্পাদক এ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তাপস সরকার হত্যা মামলা চার্জশিটভুক্ত আসামি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি চক্রের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো: ফারুকের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা। বিলুপ্ত কমিটির সহ সভাপতি নুরুজ্জামান বিগত তত্ববধায়ক সরকারের আমলে দায়ের হওয়া অস্ত্র আইনের একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী।
এছাড়া ২০০৭-২০০৮ শিক্ষাবরষর শিক্ষার্থী ও সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সহ সভাপতি আল মোকররম পলাশ বিবাহিত হয়েও সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন।
বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বায়জিদ মিয়া সজলের নামে রয়েছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ালী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পুলিশের উপর হামলার মামলা। এসময় তিনি ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।
এছাড়া মহিউদ্দিন চৌধুরী ব্লক থেকে প্রার্থী হয়েছেন ২০০৬-২০০৭ সেশনের শিক্ষার্থী রেজাউল হক রুবেল, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের আলামিন রিমন, জিয়াউর রহমান, ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের এইচএম তারেকুল ইসলাম, জিয়াদ ইমন, আমিনুল ইসলাম রাসেল, মুনমুন আহমেদ ও সৌমেন দাস জুয়েল, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের জাহাঙ্গির আলম, একই শিক্ষাবর্ষের মোহাম্মদ ইলিয়াস, মাহফুজুর রহমান, মিনহাজুল ইসলাম, সায়ন দাস গ্রুপ্ত ও শরিফুল ইসলাম।
এদিকে নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারিদের মধ্য থেকে এবার চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করার কথা রয়েছে। এ জন্য এ পদের ১৭ জন প্রার্থী মেয়রের কাছে তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছে। সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীরা গত ৮ এপ্রিল নগর ভবনে আজম নাছির উদ্দীনের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে গেলে তিনি বলে দেন, ‘হত্যা মামলার আসামিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অভিযুক্তদের কমিটির মূল দুই পদে আনার সুযোগ নেই।’
জানা গেছে, আ জ ম নাছির ব্লকের সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবু তোরাব পরশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। এ গ্রুপ থেকে সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন ইকবাল হোসেন টিপু।
ভিএক্স গ্রুপ থেকে প্রার্থী হওয়া মিজানুর রহমান বিপুল তাপস সরকার হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী। বর্তমানে পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক রয়েছেন। এ গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছেন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের দুর্জয়।
এছাড়া বাংলার মুখ গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছেন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের আমির সোহেল।
কনকর্ড গ্রুপ থেকে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী বিগত কমিটির আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। এ গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছে বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নূরনবী প্রিন্স।
একাকার গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছেন ইমাম উদ্দিন ফয়সাল পারভেজ। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কনকর্ড গ্রুপের সাবেক নেতা ও সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হোসেনকে হত্যা প্রচেষ্টা মামলার প্রধান আসামী পারভেজ।
এছাড়া উল্কা গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছেন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের মুসলে তুহিন।
আরএস গ্রুপ থেকে প্রার্থী হয়েছেন একই সেশনের রকিবুল হাসান দিনার। এছাড়া গ্রুপের বাইরে আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন অভি ও একই কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য ইফতেখার উদ্দিন আয়াজ।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক দেলাওয়ার শাহজাদা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে পরিচ্ছন্ন ও যোগ্য নেতাকর্মীদের মধ্য থেকেই চবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হবে। আগামী ১১ ও ১২ মে অনুষ্ঠেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে পরামর্শ করেই কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদক এ কমিটি অনুমোদন করবেন।’
এসআর/এটি/একুশে